রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকারগুলোর অন্যতম সদরঘাট। নৌপথে ঢাকায় প্রবেশ কিংবা লঞ্চে ঢাকা ছাড়ার একমাত্র পথ এটি। কোর্টে আসা-যাওয়া বা ব্যবসার কাজেও এই এলাকায় প্রতিদিন লাখো মানুষের সমাগম ঘটে। মহল্লায় মহল্লায় কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে চাল, আলু, পেঁয়াজ, ফলমূলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক দ্রব্যের আড়ত এখানে। আছে সরকারি-বেসরকারি ঐতিহ্যবাহী অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ঐতিহাসিক অনেক স্থাপনারও অবস্থান সদরঘাটের কাছাকাছি।
নানা কারণে এই এলাকাটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও যানজটের কারণে এখানে আসার কথা ভাবলে আঁতকে ওঠেন অনেকে। দিনের পর দিন চলা তীব্র যানজটে নাজেহাল-হয়রান এই এলাকার বাসিন্দা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে দূর-দূরান্ত থেকে আসা যাত্রী ও যানবাহনের চালকেরা।
গুলিস্তান-সদরঘাট এলাকা ঘুরে, পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ, যানবাহনের চালক-যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যানজটের বেশ কয়েকটি কারণ। তারা জানান, দক্ষিণের পথে অনেকটা বাধাহীনভাবেই রাজধানীতে প্রতিদিন ঢুকছে অনুমোদনহীন বাস। এসব অতিরিক্ত যানবাহনের অধিকাংশ গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া এলাকায় চলে আসছে। তাছাড়া শিথিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে সড়ক ও ফুটপাত দখল, ব্যাটারিচালিত রিকশা এবং রাইড শেয়ারিংয়ের মোটরসাইকেলের এলোমেলো চলাফেরা, অবৈধভাবে পার্কিং বাড়িয়ে দিচ্ছে যানজটের তীব্রতা।
রাস্তার ওপর দোকান
গুলিস্তানের আশেপাশে একটু ঘুরলেই দেখা যাবে, সড়কের বেশিরভাগ অংশ দখল করে বসানো হয়েছে দোকানপাট। গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে থেকে গোলাপশাহ মাজার পর্যন্ত একমুখী চলাচলের সড়কটি চার লেনের। দু'পাশের ফুটপাত, সঙ্গে ওই সড়কের তিনটি লেনে দোকানপাট। সেখানে একটি গাড়ি কোনোমতে জায়গা করে নিয়ে চলতে পারে।
সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্স থেকে সুন্দরবন স্কয়ারের পাশ দিয়ে ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত সড়কটিও হকারদের চলে গেছে।
যানজটের অন্যতম কারণ ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি
গুলিস্তান-সদরঘাট রওনা দিলেই শুরু হয় নতুন এক ভোগান্তি। রাস্তার দু'পাশে অগণিত ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি। বাধাহীনভাবে অর্ধেক রাস্তা দখল করে রাস্তার ওপরেই গাড়ি পার্কিং করে মালামাল ওঠানামার কাজ করছে এসব প্রতিষ্ঠান।
শুধু রায় সাহেব বাজার থেকে সিদ্দিক বাজার পর্যন্তই রয়েছে শতাধিক ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির দোকান। সেখানে মালামাল নেওয়ার জন্য দৈনিক হাজারো কাভার্ড ভ্যান এবং পিক-আপ আসে, যেগুলো রাস্তার দুই পাশে মালামাল ওঠানো পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে। এতে করে চার লেনের সড়ক হয়ে যায় দুই লেন। ফলে অন্যান্য যানবাহনের স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন ঘটে।রায়সাহেব বাজার থেকে তাঁতিবাজার–সিদ্দিক বাজার পর্যন্ত মোট ১১১টি ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির খোঁজ পেয়েছে বাংলা ট্রিবিউন। এর অধিকাংশেরই লাইসেন্স নেই বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এর মধ্যে রায়সাহেব বাজার থেকে তাঁতিবাজার পর্যন্ত ৪১টি ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি রয়েছে, আর তাঁতিবাজার থেকে সিদ্দিকবাজার পর্যন্ত আছে ৭০টি ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি।
অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড
ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির গাড়ি ছাড়াও পুরো ধোলাইখাল জুড়ে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ডও দায়ী এই যানজটের জন্য। ধোলাইখাল এলাকায় গেলেই দেখা যাবে সড়কের একপাশ জুড়ে ট্রাক পার্কিং করে সড়ক দখল করে আছে। এজন্য যাত্রাবাড়ী, ধোলাইপাড় বা জুরাইন এলাকা থেকে আসা যানবাহন নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে না। যার ফলে ধোলাইখাল এলাকাতেও তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। সেটার প্রভাব পড়ে আবার গুলিস্তানের এই সড়কে।
ভুক্তভোগীরা কী বলছেন
এই এলাকার যানজটে সাধারণ মানুষ যেমন অতিষ্ঠ, তেমনি বিরক্ত বাস ও বিভিন্ন যানবাহনের চালকেরাও। যানজটের বিষয়ে ভিক্টর ক্লাসিক বাসের চালক সাইফুল ইসলাম বলেন, গুলিস্তান থেকে সদরঘাটের এই সাড়ে তিন কিলোমিটার রাস্তা পার হতে মাঝে মধ্যে তিন ঘণ্টা সময়ও লাগে। অথচ পথ মাত্র ৫ মিনিটের। পুরো শহরের কোথাও জ্যাম না থাকলেও গুলিস্তানে জ্যাম থাকবেই। এই জ্যামে বসে যে জীবনের কতো হাজার ঘণ্টা পার করেছি তার হিসাব নাই।
তিনি আরও বলেন, সবাই শুধু জ্যাম হলেই আমাদের দোষ দেয়। বাস চালকদের কারণে নাকি জ্যাম হয়। কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। আপনি যদি এই রোডের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘুরে দেখেন তাহলে দেখবেন যে সবাই যে যার আগে পারছে, যেতে চাইছে। কেউ কোনও সিরিয়াল মানছে না, ওভারটেক করার প্রবণতা সবার মধ্যে আছে। কিন্তু কথা হচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকা যানবাহনের কারণে মূল জ্যামটা বাঁধে। পুলিশ যদি মূল সড়কের ওপরে গাড়ি রাখা বন্ধ করে তাহলে এখানে আর জ্যাম লাগবে না।তাঁতি বাজার মোড় সংলগ্ন এলাকায় মহিউদ্দিন নামের এক প্রাইভেটকার চালক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, রাজধানীর অন্য সব এলাকা থেকে এই এলাকায় আইনশৃঙ্খলার যথেষ্ট ঘাটতি আছে। বিশেষ করে ট্রাফিক ব্যবস্থা খুব দুর্বল। এই রাস্তায় গাড়ি চলাচলের জন্য কোনও নিয়মনীতি নেই। কার, বাস বা মোটরসাইকেলের জন্য নির্দিষ্ট কোনও লেন নেই। মূল সড়কসহ সবজায়গাতেই অটোরিকশা আর মোটরসাইকেলের দৌরাত্ম। যানজটের কারণে এদিকে গাড়ি নিয়ে আসতে ইচ্ছে করে না। এদিকে আসলেই জ্যামে বসে ঘণ্টা পার হয়ে যায়।মোটরসাইকেল চালক তুহিন খোন্দকার বলেন, পড়াশোনার সুবাদে গত সাত বছর ধরে আমি লক্ষীবাজার এলাকায় বসবাস করি। পড়াশোনার পাশাপাশি ধানমন্ডিতে একটা জব করি। সপ্তাহে ছয় দিন অফিসে করতে হয়। দুঃখের বিষয় প্রতিদিন গুলিস্তানের জ্যামে আমার দুই আড়াই ঘণ্টা কেটে যায়। জ্যামে বসে থাকার ভোগান্তি থেকে বাঁচতে মোটরসাইকেল কিনেছিলাম। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হলো না। এখানকার অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়ক সবজায়গাতে জ্যাম থাকে। মূল সড়কের উপর শত শত কভার ভ্যান ট্রাক পার্কিং করা থাকে। অর্ধেক রাস্তা তাদের দখলে থাকে। নিয়মনীতির কোন তোয়াক্কা নেই। সরকারের পটপরিবর্তনের পর এই সড়কের যানজট আরও বেড়ে গেছে। একজন রিকশাচালক পর্যন্ত এখন পুলিশের কমান্ড মানে না। অটোচালকদের মূল সড়কে উঠতে নিষেধ করলেও কথা শুনে না।
সমাধান কী
পুরান ঢাকার সূত্রাপুর এলাকার বাসিন্দা হাসিবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ট্রান্সপোর্ট এজেন্সিগুলো যত্রতত্রভাবে গাড়ি পার্কিংয়ের ফলে সবচেয়ে বেশি যানজট সৃষ্টি হয়। পুলিশ দেখেও কিছু বলে না। উল্টো পয়সা খেয়ে তাদের দীর্ঘসময় গাড়ি রাখার সুযোগ করে দেয়। এই এলাকার অবৈধ সবগুলো ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি যদি অন্য কোথাও স্থানান্তর করা যায় তাহলে এই এলাকার ৭০ শতাংশ জ্যাম কমে যাবে। যানজট নিরসনে সরকার যদি কেবল এই পদক্ষেপটুকু গ্রহণ করে তাহলে সাধারণ জনগণ উপকৃত হবে।কথা হয় বেশ কয়েকটি ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। বাংলা ট্রিবিউনকে তারা বলেন, এই এলাকায় শুধু যে অসংখ্য ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি আছে তাই নয়, অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও রয়েছে। রাজধানীর কোথাও সম্ভবত এতো কাছাকাছি এতাগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠান নেই। তাছাড়া এখানে কোর্টকাচারি থাকায় সপ্তাহে পাঁচ দিন তো এমনিই যানজট লেগে থাকে। কোর্টে হাজার হাজার মানুষ আসে। সদরঘাট এলাকায় যানজটের এটাও একটা বড় কারণ।
মিলন ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড কুরিয়ার সার্ভিসের দায়িত্বরত কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এটা আসলে বাণিজ্যিক এলাকা। এখানকার অনেক ব্যবসা আসলে ট্রান্সপোর্টের ওপর নির্ভরশীল। এখান থেকে যদি ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি স্থানান্তর করা হয় তাহলে অন্যান্য ব্যবসায়ীদের খরচ বেড়ে যাবে। তবে স্থায়ীভাবে যানজট নিরসনের জন্য প্রয়োজন টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। সেক্ষেত্রে ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি স্থানান্তর অন্যতম পন্থা।
অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ডের বিষয়ে ধোলাইখালের বাসিন্দা আনিসুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দীর্ঘদিন থেকেই ধোলাইখালের মূল সড়কের ওপরে অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ড করেছিল আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। তারা সড়কের ওপরে ট্রাক বা পিকআপ পার্কিং করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছে। এবার তার হাত বদল হয়ে সেই অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ডের দায়িত্ব নিয়েছে বিএনপি'র নেতাকর্মীরা। সরকার পতনের পর স্থানীয়রা ভেবেছে এবার আর এখানে ট্রাকস্ট্যান্ড থাকবে না। কিন্তু তা আর হলো না। ধোলাইখাল থেকে যদি এই অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড বন্ধ করা হয় তাহলে পুরান ঢাকা যানজট থেকে মুক্তি পাবে।
প্রশাসন কী বলছে
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে রায় সাহেব বাজার মোড়ে দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশ সাত্তার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড আর ট্রান্সপোর্ট যদি এখান থেকে সরে যায় তাহলে সত্যিকার অর্থেই যানজট কমে যাবে। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ভূমিকা পালন করা জরুরি। এছাড়াও সাধারণ মানুষের নৈতিক দায়িত্ব পালনেও যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখবে।
সাধারণ মানুষের নৈতিক দায়িত্ব আছে— উল্লেখ করে এই পুলিশ সদস্য বলেন, ওভারব্রিজ থাকা সত্ত্বেও মানুষ তা ব্যবহার করছে না। রাস্তার মাঝখান দিয়ে চলাচল করছে। এতে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। হরহামেশা এমন দৃশ্য দেখা যায় যে মানুষ হাত দিয়ে গাড়ি থামিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে অথচ পুরো ওভারব্রিজ খালি পড়ে আছে।সদরঘাট থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত স্থায়ীভাবে যানজট নিরসনের বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নজমুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আইন আসলে সবার জন্য সমান। কিন্তু এখন কেউই আইন মানতে চায় না। এখন সবাই স্বাধীন। আইন শুধু এখন পুলিশের জন্য। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যেসব গাড়ি আছে সেগুলোও কিন্তু অবাধে যেখানে সেখানে রাস্তার ওপর পার্কিং করা হয়। আর শুধু দোষ পড়ে গণপরিবহনের। আমরা গত মাসে ১০ হাজারের অধিক বাস জরিমানা করেছি। সড়কে যেসব অবৈধ যানবাহন চলাচল করছে আমরা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করছি।
অবৈধ ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির স্থানান্তর কিংবা অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদের বিষয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি স্থানান্তর কিন্তু আমাদের কাজ না। তাদের ট্রেড লাইসেন্স আছে কি নাই সেটা কিন্তু পুলিশের অন্য আরেকটা বিভাগ দেখে। তাছাড়া এখানে সিটি করপোরেশনেরও কাজ আছে। যানজট নিরসনে আমরা আমাদের সর্বোচ্চটুকু চেষ্টা করছি।
অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড এবং অবৈধ ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রসাশক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জায়গার ওপর অবৈধ স্থাপনা থেকে শুরু করে সড়কের ওপর থাকা অবৈধ সবকিছু উচ্ছেদ হবে। আমাদের এখন ফুটপাতে উচ্ছেদ অভিযান চলমান আছে। পর্যায়ক্রমে অবৈধ সবকিছুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন