কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলা শহরের হাসপাতাল মোড় থেকে তবকপুর ইউনিয়নের বড়ুয়া তবকপুর বাজারগামী পাকা সড়ক। এই সড়ক ধরে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে বড়ুয়া তবকপুর বাজার। বাজারের কাছে পাকা সড়কের ওপর নির্মিত সেতুটি ভেঙে গিয়েছিল সাত বছর আগে। ২০১৮ সালের বন্যায় পিলার ভেঙে সেতুটি উল্টে যায়। সংযোগ সড়ক বিচ্ছিন্ন হয়ে সৃষ্টি হয় বিশাল গর্ত। ভেঙে পড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা। সেই থেকে প্রতিদিন ভোগান্তি পোহাচ্ছেন স্কুল শিক্ষার্থীসহ হাজারো মানুষজন।
দীর্ঘ সাত বছর ধরে চলা ভোগান্তি নিরসনে এগিয়ে আসেনি কেউ। সড়কের বিচ্ছিন্ন ওই স্থান মেরামত কিংবা নতুন সেতু নির্মাণের কোনও উদ্যোগ নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। নারী-শিশু কিংবা রোগী কারও ভোগান্তি বিবেচনায় নেয়নি কেউ। এ নিয়ে হতাশার সঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, উলিপুর শহরের হাসপাতাল মোড় থেকে বড়ুয়া তবকপুর হয়ে ইউনিয়নের রসুলপুর চুনিয়ারপার মোড় পর্যন্ত প্রায় আট কিলোমিটার পাকা সড়কটি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর নির্মাণ করেছে। সড়কের পাঁচ কিলোমিটার দূরত্ব অংশে বড়ুয়া তবকপুর বাজারের কাছে নির্মিত সেতুটি তৈরির চার বছর পর ২০১৮ সালে বন্যার পানির তোড়ে ভেঙে যায়। এরপর থেকে চলাচলে ভোগান্তি পোহাচ্ছে কয়েক হাজার মানুষ। মানববন্ধন, সংবাদ প্রকাশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপ কামনাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেও ভোগান্তি থেকে মুক্তি মেলেনি স্থানীয়দের।
সেতু সংলগ্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে. সড়কের মাঝে যেন বিশাল ‘পুকুর’ সৃষ্টি হয়েছে। দুই পাশে আবাদি জমি বিলীন হয়েছে প্রায় এক একর। উল্টে থাকা সেতু থেকে লাফিয়ে পড়ে শিশু শিক্ষার্থীরা গোসল খেলায় মেতেছে। উলিপুর প্রান্ত থেকে বিভিন্ন যানবাহনে করে মানুষজন এসে সেতুর উত্তর প্রান্তে নামছেন। কেউ ড্রামের ভেলা করে আবার কেউ কৃষিজমির আইল ধরে অপর প্রান্তে পৌঁছাচ্ছেন। এরপর অবশিষ্ট পথ হেঁটে গন্তব্যে রওনা হচ্ছেন। নারী-পুরুষ, শিশু কিংবা ব্যবসায়ী সবাইকে একই ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। যানবাহনহীন পরবর্তী তিন কিলোমিটার পথে ভোগান্তি আর দুর্ভোগ পোহাতে হয় সবার।
উলিপুর থেকে নিজের দোকানের মালামাল কিনে নিয়ে আসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মুসা মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সাত বছর ধরে সেতু ভেঙে পড়ে আছে। চলাচল করা যায় না। আমাদের ভোগান্তির শেষ নেই। লোকজন পারাপারে সমস্যা হয়। মালামাল পরিবহন করতে পারে না। একজন যদি অসুস্থ হয় তার চিকিৎসা করাতে একটা যে অ্যাম্বুলেন্স আসবে, সে উপায়ও নেই। ১৫-১৬ কিলোমিটার ঘুরে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া লাগে। তখন ওই রোগীটার কী অবস্থা হয় বোঝেন।’
‘কত খবর হইলো। সবাই আসে আর দেখি যায়। আমাদের মুক্তির ব্যবস্থা কেউ করে না’ আক্ষেপ করে বলেন মুসা।
মুসার সঙ্গে কথা বলার আগে দেখা মেলে স্থানীয় বাসিন্দা ইউনুস আলীর সঙ্গে। সেতু সংলগ্ন সড়ক বিচ্ছিন্ন স্থানটি প্লাস্টিকের ড্রামের ভেলা দিয়ে পার হতে হতে তিনি বলেন, ‘সাত বছরের বেশি সময় ধরে এই ভোগান্তি। সেতুটা হইলে আর সমস্যা থাকে না। দুই পাশে পাকা রাস্তা। খালি সেতুটা ঠিক হইলে হয়। প্রতিদিন মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না। এমন একটা অবস্থা যে এই পাশে আসলেও কষ্ট, ওপাশে গেলেও কষ্ট। সেতু থাকলে গাড়ি চলতো। এত বছর ধরে সেতুটা ভেঙে পড়ে আছে। দেখার কেউ নেই, ভোগান্তি শেষ হয় না।’
kurigram-1
২০১৮ সালের বন্যায় পিলার ভেঙে সেতুটি উল্টে যায়
সেতুর দুই পাশে ভাঙনে প্রায় এক একর জমি হারিয়েছেন কৃষক আব্দুল কাইয়ুম। বছরের পর বছর আবাদ করতে না পারার জন্য তিনি দায় দিচ্ছিলেন সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের ব্যক্তিদের নিষ্ক্রিয়তা আর হেয়ালিপনাকে। এই কৃষক বলেন, ‘মোর এক একর জমি খালত পড়ছে। কত আন্দোলন, কত সাংবাদিক আনি খবর করলোং। কোনও লাভ হয় নাই। কাইয়ো কোনও কাজ করে না। খালি আইসে আর দেখি যায়।’
স্থানীয় বাসিন্দা স্কুলশিক্ষক মঞ্জুরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই পথে তবকপুর ও চিলমারীর থানাহাট ও রানীগঞ্জ ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষের যাতায়াত। ২০১৮ সালে এটি ভেঙে যাওয়ার পর চেয়ারম্যান, এমপিসহ অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেতু নির্মাণসহ সড়কের অংশটি মেরামতের জন্য অনেক চেষ্টা-তদবির করা হয়েছে। তৎকালীন মতিন এমপিকে বারবার অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু সেতু নির্মাণ তো দূরের কথা তারা দেখতেও আসেননি। প্রতিদিন কত মানুষ ভোগান্তি নিয়ে যাতায়াত করছে, তা বলে বোঝানো যাবে না। আমরা চাই দ্রুত ব্রিজ নির্মাণ করে ভোগান্তি দূর করা হোক।’
বড়ুয়া তবকপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিম বলেন, ‘এই সড়ক ধরে আমার স্কুলে অনেক শিক্ষার্থী যাতায়াত করে। অনেক ঝুঁকি নিয়ে শিশুদের যেতে হয়। ড্রামের ভেলা দিয়ে চলাচল করতে হয়। কিন্তু এটা কী কোনও স্থায়ী সমাধান হতে পারে। আজ সাত বছর ধরে এই ভোগান্তি চলছে।’
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে সীমাহীন ভোগান্তি চলমান থাকলেও সেতুটি কোনও প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছে তার হদিস মিলছে না। উলিপুর উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় কিংবা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের কেউ বলতে পারছে না সেতুটি কার। সবার একই অজুহাত, ‘খোঁজ নিয়ে জানতে হবে।’
উপজেলা প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার বলেন, ‘যেহেতু অনেক আগে থেকে সেতুটি অকেজো, তাই নতুন সেতুর প্রস্তাবনা গিয়ে থাকতে পারে। আমি নতুন যোগদান করেছি। খোঁজ নিয়ে বিস্তারিত বলতে পারবো।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আতাউর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে নতুন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করতে বাঁশ কিংবা কাঠ দিয়ে একটি অস্থায়ী সেতু নির্মাণ করার জন্য আমি অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন