সাবিয়া সেজা। বয়স এক বছর চার মাস। জন্মসনদে তার ঠিকানা পশ্চিম শেলাবুনিয়া, ৮ নম্বর ওয়ার্ড, মোংলা পোর্ট পৌরসভা। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ডাটাবেজে পশ্চিম শেলাবুনিয়ার অবস্থান ৯ নম্বর ওয়ার্ডে। এ ছাড়া পৌরসভা থেকে দেওয়া জন্মসনদে গ্রামের নামের বানান ‘শেলাবুনিয়া’ লেখা হলেও বিবিএসের খাতায় সেটা ‘শেহালাবুনিয়া’। জন্মসনদে ইংরেজি বানান ‘West Shelabunia’ লেখা হলেও বিবিএসের ডাটাবেজে সেটা ‘Pashchim Shehalabunia। ঠিকানার হরেক রকম বানান ও বিভ্রান্তি নিয়ে জীবনের পথ চলা শুরু করেছে দেড় বছরের শিশুটির। দেশের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে একই চিত্র। বানানজনিত ভুল ঠিকানা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশের কোটি কোটি মানুষ।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, ঠিকানা জটিলতায় জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), পাসপোর্ট, বিভিন্ন সার্টিফিকেট, জমি রেজিস্ট্রেশন, বিদেশে উচ্চশিক্ষাসহ নানা কাজে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এখন এ ধরনের প্রতিটা কাজে ইংরেজিতে ঠিকানা দরকার পড়ছে। স্কুলে ভর্তিতে জন্মনিবন্ধন লাগছে। সেখানে ঠিকানার ইংরেজি বানান লাগে। পাসপোর্ট করতে এনআইডি বা জন্মনিবন্ধন লাগছে। সেখানেও ইংরেজিতে ঠিকানা লাগে। অথচ এনআইডিতে ইংরেজিতে ঠিকানা নেই। এদিকে কোনো এলাকার নামের সঠিক বানান কোনটি তা ঠিক করতে পারছে না সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। এসব অফিসের কর্মচারীরা নিজের মর্জিমাফিক ঠিকানার ইংরেজি বানান লিখে দিচ্ছেন। অনেক সময় ফরম পূরণ করে দিলেও কম্পিউটারে তথ্য ইনপুট দেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মীরা ভুল করছেন। পরে সেটা সংশোধন করতে হয়রানি হচ্ছে। এ ছাড়া ঠিকানা সংশোধনেও বিপত্তিতে পড়তে হচ্ছে জানিয়ে কেউ কেউ বলেন, ৪০-৫০ বছর আগে হোল্ডিং নম্বর দেওয়ার সময় একটা ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী হয়েছে বিদ্যুৎ বা অন্যান্য ইউটিলিটির বিল। পরে যখন দেখা গেল ঠিকানাটা ভুল, তখন সংশোধন করতে গেলে হচ্ছে না। কারণ সংশোধনের সময় ইউটিলিটি বিলের কপি দিতে হয়। মিল না থাকলে সংশোধন হয় না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ভুলের ওপরই থাকতে হচ্ছে। স্থানীয় সরকার ইউনিটগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, বিষয়টা নিয়ে তারাও ঝামেলায় আছেন। ভুলের কারণে জন্মনিবন্ধন সনদ সংশোধনের প্রচুর আবেদন জমা পড়ছে। আর সংশোধিত সনদ পেতে মাসের পর মাস লেগে যাচ্ছে। এতে নাগরিকদেরও হয়রানি বাড়ছে, তাদেরও চাপে থাকতে হচ্ছে। তাদের মতে, এনআইডি সার্ভারে যেমন ১০ কোটির বেশি নাগরিকের ডাটাবেজ সংরক্ষিত আছে, তেমনি বিভাগ, জেলা, উপজেলা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, ডাকঘর ও গ্রামের বাংলা ও ইংরেজি নাম সুনির্দিষ্ট করে গেজেট জারি ও অনলাইনে ডাটাবেজ করলে মানুষের ঠিকানা সংকট কাটত। অনলাইনে ক্লিক করেই বিভিন্ন ফরম নির্ভুলভাবে পূরণ করা যেত। এ নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, সব গ্রাম নিয়ে আলাদা কোনো গেজেট নেই। ইউনিয়নগুলোর পৃথক গেজেট আছে। যখন ইউনিয়ন করা হচ্ছে তখন সেখানে কোনো মৌজা গ্রাম, ওয়ার্ড অন্তর্ভুক্ত তা উল্লেখ থাকছে। গ্রাম নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিলে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা বা জেলার ওয়েবসাইট যেভাবে উল্লেখ আছে সেটি অনুসরণ করতে হবে। তবে ডজনের বেশি জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, অধিকাংশ পৌরসভার ওয়েবসাইটে গ্রাম/মহল্লার নাম নেই। অনেক ইউনিয়ন পরিষদের ওয়েবসাইটে বাংলায় গ্রামের নাম থাকলেও ইংরেজিতে নেই। এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তা পবন চৌধুরী বলেন, আমরা ইউনিয়ন পর্যন্ত দেখি। গ্রাম/মহল্লা কোনো প্রশাসনিক ইউনিট নয়। তাই এটার নাম নিয়ে মন্ত্রণালয়ের কোনো গেজেট বা ডাটাবেজ নেই।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো- বিবিএসের সিস্টেম অ্যানালিস্ট যতন কুমার সাহা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারিভাবে গ্রামের নাম নিয়ে সমন্বিত গেজেট নেই। শুমারির সময় আমরা স্থানীয় সরকার ইউনিটগুলোর গেজেট যাচাই করি। ইংরেজি বানান নিয়ে সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোর কর্মচারী, জনপ্রতিনিধি, এলাকার প্রবীণ ও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে গ্রাম/মহল্লার তালিকা করি। বিবিএস যে তালিকাটি দিয়েছে, সেটাই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য।
তবে বিবিএসের ডাটাবেজ ব্যবহার হয় না কোথাও। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মোংলা পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের নানা ডকুমেন্টে ঠিকানায় কোথাও গ্রামের নামে, উপজেলার নামে, কোথাও পোস্ট অফিসের ঠিকানায় বিভ্রান্তি রয়েছে। কারও ঠিকানায় গ্রামের নাম শেলাবুনিয়া, তার মায়ের ঠিকানায় শেহলাবুনিয়া। নাগরিকদের নথি ঘেঁটে শেলাবুনিয়া, শেহলাবুনিয়া, শেহালাবুনিয়া- এই তিনটি বানান পাওয়া গেছে। ইংরেজি বানান ব্যবহার করা হয়েছে Shelabunia, Shahalabunia, Shehalabunia। আবার শেহলাবুনিয়ার আগে পূর্ব, মধ্য, পশ্চিম লিখতে জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টে East, Middle, West ব্যবহার করা হলেও বিবিএসের ডাটাবেজে Purba, Madhya, Pashchim লেখা রয়েছে। ভূমি অফিসগুলো লিখছে সেলাবুনিয়া বা সেহলাবুনিয়া (দন্ত্য ‘স’ দিয়ে)। অন্যদিকে অনলাইনে পাসপোর্টের আবেদন পূরণ করতে গেলে পোস্ট অফিসের নাম ইংরেজিতে আসছে Seulabunia। এমনকি উপজেলার নামটিও কোথাও লেখা হচ্ছে মংলা, কোথাও মোংলা। পৌরসভাটির নির্বাহী কর্মকর্তা অমল কৃষ্ণ সাহা পুরনো গেজেট ঘেঁটে ১১টি গ্রামের নাম দেন। এর মধ্যে রয়েছে শেহলাবুনিয়া পূর্ব ও শেহলাবুনিয়া পশ্চিম। তবে এখনো অনেকের জন্মনিবন্ধনে লেখা হচ্ছে শেলাবুনিয়া। তবে ইংরেজি নামের কোনো গেজেট নেই জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, বহুদিন ধরে যেভাবে চলে আসছে, আমরা সেভাবেই লিখছি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন