নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠনে অনুসন্ধান কমিটি গঠনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি। সংস্কার করা হচ্ছে নির্বাচন ব্যবস্থা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে টানা ১৫ বছরের শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা ও নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণ বিষয়ে বিপরীতমুখী আলোচনা চলছে নানা মহলে। ‘গণহত্যার’ দায়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তোলা হয়েছে বেশকিছু রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে।
অবশ্য, নির্বাচন নিয়ে বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে বারবার তাগিদ দেওয়ার মধ্যেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে কি না, সেই আলোচনায় দেখা যাচ্ছে দ্বিধা-বিভক্তি। কেউ বলছেন আইনের কথা, কেউ বলছেন জনগণের রায়ের কথা, তো কেউ বলছেন রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের কথা। তবে, সব পক্ষই আওয়ামী লীগের শাস্তির দাবি তুলছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে প্রস্তুতির কথাও বলছেন তারা।
আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না, সে সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোর ‘ঐকমত্যের ভিত্তিতে’ নির্ধারিত হবে, উল্লেখ করে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপেদষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, অন্তবর্তী সরকার তার (আওয়ামী লীগ) ভাগ্য নির্ধারণ করবে না। কারণ, এটি রাজনৈতিক সরকার নয়। আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না, সে সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোর ‘ঐকমত্যের ভিত্তিতে’ নির্ধারিত হবে।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান সর্বপ্রথম নির্বাচনের সময় নিয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণ এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই হওয়া উচিত।’ তবে, তিনি ধৈর্য ধারণের ওপরও জোর দেন।
বিদেশি গণমাধ্যমে দেওয়া সেনাপ্রধানের সাক্ষাৎকার প্রচার হওয়ার পর তা ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছিল। কারণ, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকার কিংবা সরকার সংশ্লিষ্ট কারও দিক থেকে নির্বাচনের সময়সীমা উল্লেখ করে এটিই ছিল প্রথম কোনো বক্তব্য।
এর আগে শুরু থেকেই বিএনপি নির্বাচনের জন্য একটি রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছিলো। কিন্তু, নির্বাচন কত দিনে হবে বা হওয়া উচিত, সে বিষয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের দিক থেকে কোনো বক্তব্য আসেনি।
সেনাপ্রধানের বক্ত্যেবের পর নির্বাচনের সময় নিয়ে কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি জানিয়েছিলেন, আগামী বছরের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব হতে পারে। তবে, এতে অনেকগুলো ‘ফ্যাক্টর’ আছে বলে তিনি মনে করেন। এটি তার প্রাথমিক অনুমান বলেও তিনি জানান। যদিও এই বক্তব্য নিয়ে সমালোচনা হয়। তখন ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, সেনাপ্রধান ও আইন উপদেষ্টা যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা তাদের ব্যক্তিগত।
পরে জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন যে, কখন নির্বাচন হবে, এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
সেনাপ্রধানের বক্তব্যের এক মাস ৫ দিন পর ২৯ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার দেশের নির্বাচনি কাঠামোকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন তদারকির জন্য ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করে। এর মধ্যে দিয়ে শুরু হয় নির্বাচনের প্রস্তুতি।
ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন ও এতে আ.লীগের অংশগ্রহণ নিয়ে যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
বিএনপি: দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ভোটের মাঠে সক্রিয় হচ্ছে।
নির্বাচন প্রস্তুতির বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাইজিংবিডিকে বলেন, এখন বিএনপির ‘ফার্স্ট প্রায়োরিটি’ নির্বাচন। দলের কার্যক্রম সেই মোতাবেক চলছে। সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন প্রক্রিয়া, প্রশাসন ও বিচার বিভাগ—এই তিনটি সেক্টরে সংস্কার দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন। এসব সংস্কার শেষে আমরা দ্রুত নির্বাচন চাই।
বিএনপির নির্বাচনের প্রস্তুতি কেমন চলছে? এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির মহাসচিব বলেন, বিএনপি সব সময়ই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত থাকে। তবে, সময়ে সময়ে এর নানা দিক আপডেট কিংবা কিছু পরিবর্তন হয়। এই মুহূর্তে সেগুলোই আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করছি। পাশাপাশি, দলের সংস্কার কমিটিগুলো কাজ করছে। দলের পক্ষ থেকে খুব শিগগিরই নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশ করা হবে। এছাড়া, ৩১ দফা বাস্তবায়নে দেশব্যাপী নেতাকর্মীরা গণসংযোগ করছেন।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম রাইজিংবিডি বলেন, আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই, ২০১৮ সালে যখন নির্বাচন এলো, আমাদের বলা হলো, আপনারা কি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত? আমরা কিন্তু বলেছি, হ্যাঁ অবশ্যই প্রস্তুত। সেই মুহূর্তে আমরা প্রতি আসনে ৩ থেকে ৪ জন করে প্রার্থী দিয়েছি। যদিও সেই নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকার আগের রাতেই জোর করে নিয়ে গেছে। অথচ, সেই নির্বাচনে আমাদের পুরো পার্টিসিপেশন ছিল; এবং পুরোটাই ছিল।
দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের পক্ষে নয় বিএনপি, এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বিএনপি কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পক্ষে নয়।
এদিকে, বুধবার (১৩ নভেম্বর) ঠাকুরগাঁওয়ে নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের মতামত দেওয়া ঠিক হবে না। এটা রাজনৈতিক দলের নয়, জনগণের সিদ্ধান্ত।
‘জনগণ সিদ্ধান্ত দেবে, কে রাজনীতি করবে; কে করবে না এবং সেটা হবে নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচনে জনগণের কাছে যারা খারাপ, তারা বাতিল হয়ে যাবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, তিনি আর কোনো নতুন বয়ান চান না। এখন একমাত্র বয়ান হচ্ছে, গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসতে হবে।
১২ নভেম্বরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশে একটি নির্বাচিত সরকার গঠিত হতে হবে, যারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে, জবাবদিহি থাকবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আপনি যদি নির্বাচিত না হন, তাহলে আপনার তো কোনো দায়বদ্ধতা নেই, জবাবদিহি নেই। হাসিনার কোনো জবাবদিহি ছিল না। কারণ, সে তো নির্বাচিত ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে উনি যে বাকশাল করেছিলেন—একদলীয় শাসন; ওনারা নির্বাচনের ধার ধারেননি। ওই জন্য বয়ান সৃষ্টি করা হয়। সে বয়ানে উনি দেশ চালিয়ে গেছেন। হাসিনা আরেক বয়ানে চালিয়ে গেছেন। আমরা আর নতুন বয়ান চাই না।’
সম্প্রতি সরকারের উদ্দেশে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘আপনি নির্বাচনের কথা বলেন, কিন্তু নির্বাচনের কোনো ডেডলাইন দেন না। এত দ্বিধা কেন? এটা তো রহস্যজনক। আপনারা সংস্কার করবেন। অন্তর্বর্তীকালীন কী, স্কুলের হেডমাস্টার? আপনারা সংস্কারের একটা সিলেবাস তৈরি করবেন। রাজনৈতিক দলগুলোকে আগে শিক্ষাদান করবেন। মনে হচ্ছে, এটাই ইচ্ছা।’
জামায়াত ও অন্যান্য দল: নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ কি নির্বাচন করেছিল? না। তারা ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিল। তারা নির্বাচন চায়নি। এজন্য রাতের অন্ধকারে ভোট করেছিল পুলিশ আর প্রশাসন দিয়ে। যারা নির্বাচন চায় না, তাদের ওপর নির্বাচন চাপায়ে দিলে তো জুলুম হবে। এটাও একটা বৈষম্য হবে।’
নির্বাচন ও সংস্কার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলসহ সব পর্যায়ের অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। এর পর যৌক্তিক সময়ের মধ্যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে সম্মানের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিদায় নিতে হবে।’
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেছেন, ‘রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। নিষিদ্ধ করা হবে কি না, সেটা মুখ্য নয়। তবে, একটা ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়ে আসছি আমরা।’
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন:
ইসি গঠনে সার্চ কমিটি করার আগেই সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিটি গঠন করেছে। সংস্কার কাজের অগ্রগতির বিষয়ে এ কমিটির প্রধান বদিউল আলম মজুমদার রাইজিংবিডিকে বলেছেন, ‘আমাদের অগ্রাধিকার হলো একগুচ্ছ সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করা। বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে কাজ চলছে। আমরা ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাব জমা দিতে বদ্ধপরিকর। অবশ্যই, এ সময়ের মধ্যে প্রস্তাব জমা দেবো।’
আপনাদের কমিশন তো নিশ্চয় ইসি গঠনেও সংস্কার প্রস্তাব দেওয়ার জন্য কাজ করছে। এর আগেই সরকার ইসি গঠনে কমিটি করল। এত সংস্কার কমিশনের এ কাজটি অর্থহীন হতে পারে কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইনের একটি নতুন খসড়া তৈরি করা হয়েছে। তবে, সরকারের হয়ত বহুমুখী বিবেচনা আছে, তাদের বহুমুখী দায়িত্ব আছে। অনেক অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে মতামত নিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়।’
নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন করা দরকার। নির্বাচন কমিশনে যোগ্য ব্যক্তি নিয়োগ দেওয়া হলে ও আইনের সঠিক প্রয়োগ করা গেলে বর্তমান পদ্ধতিতেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব।’
অনুপস্থিত ও প্রবাসীদের ভোটারদের ভোট দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘১ কোটি ৩০ লাখ, মতান্তরে ২ কোটি প্রবাসী রয়েছে। তাদেরকে যদি নির্বাচনের প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত করতে না পারি এবং তাদের ভোটাধিকার যদি নিশ্চিত না হয়, তাহলে দেশের বিরাট জনগোষ্ঠী ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। তাই, এটা আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকার। তবে অবশ্যই এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।’
রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইনের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আসছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি পর্যালোচনায় আসছে। তবে, বলা দুরুহ। ফাইনাল কোনো সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি।’
কোনো দল ফ্যাসিবাদী বা তাদের সহযোগী হলে, তার নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধের কোনো ধারা যুক্ত হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এগুলো পুরোপুরি সরকারি সিদ্ধান্ত। সংস্কার কমিশন এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না।’
বিদ্যমান নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) আবু হেনা।
তিনি বলেন, ‘দেশের চলমান নির্বাচন পদ্ধতিই কার্যকর হতে পারে। এ পদ্ধতির সঙ্গে দেশের মানুষ পরিচিত। নির্বাচনের সফলতা নির্ভর করে নির্বাচনি আইন প্রয়োগের ওপর। নির্বাচন কমিশনে যোগ্য মানুষ দরকার।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন