লাগোয়া দুই উপজেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ ও নরসিংদীর পলাশ। আশপাশের কৃষিজমিগুলো প্রায় চার দশক ধরে রয়েছে সেচ প্রকল্পের আওতায়। সে কারণে ওই এলাকার কৃষি সম্পূর্ণই সেচনির্ভর। নেই কোনো ধরনের গভীর নলকূপ। ওই এলাকার সড়ককে চার-লেনের জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত করার কাজ করতে গিয়ে সেই সেচ কাজ ব্যাহত হয়। এর ফলে প্রায় চার বছর ধরে ওই এলাকায় সেচ বন্ধ, বন্ধ ফসল উৎপাদনও।
এ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এবার আশুগঞ্জ ও ঘোড়াশাল থার্মাল পাওয়ার-প্ল্যান্ট থেকে পাওয়া ১৯০০ কিউসেফ পানি ঠান্ডা করে কৃষি কাজে ব্যবহারের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। এই পানি ব্যবহার করেই আশুগঞ্জ ও পলাশের প্রায় ৩১ হেক্টর কৃষিজমিকে নিয়ে আসা হবে সেচের আওতায়।
‘আশুগঞ্জ-পলাশ’ নামের প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। ৪৭০ কোটি টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে ওই এলাকার এক লাখ পাঁচ হাজার ৫০ মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রস্তাবটি নিয়ে সম্প্রতি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) জাহাঙ্গীর আলম। সভায় প্রকল্পের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনার পর পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ দেওয়া হয়েছে।
জাহাঙ্গীর আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাওয়ার প্ল্যান্টের পানিকে ঠান্ডা করে সেচের কাজে ব্যবহারের একটি প্রকল্প নিয়ে পিইসি সভা করেছি। সেখানে সব পক্ষের মধ্যে নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কিছু বিষয়ে সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। সেসব সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) সংশোধন হয়ে এলে তারপর প্রকল্পটি একনেকে উপস্থাপনের প্রক্রিয়া করা হবে।’
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) সূত্রে জানা যায়, সংস্থাটি ১৯৭৮-৭৯ সালে ‘আশুগঞ্জ সবুজ প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। একই সময়ে নরসিংদীর পলাশ এলাকাতেও একই রকম একটি সেচ প্রকল্প চালু করা হয়। পরে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য এই দুটি প্রকল্প এক সঙ্গে করে ‘আশুগঞ্জ-পলাশ অ্যাগ্রো-ইরিগেশন’ নামে একটি প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন পায়।
শুরুতে পাঁচ বছরের জন্য নেওয়া হলেও কৃষি সেচের প্রকল্পটি ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা হয়। সবশেষ ২০২০ সালের জুনে এ প্রকল্পের পঞ্চম পর্যায় শেষ হয়। এরপর বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কুলিং রিজার্ভার ভরাট করা এবং আশুগঞ্জ নদী বন্দর-সরাইল-ধরখার-আখাউড়া স্থলবন্দর মহাসড়ককে চার-লেন জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত করার কাজ করতে গিয়ে বিএডিসির ওই সেচ প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়।
এ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই আশুগঞ্জ-পলাশ সেচ প্রকল্পটি প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রকল্পটির যৌক্তিকতা নিয়ে বিএডিসির উপপ্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ ওবায়েদ হোসেন বলেন, আগের প্রকল্পটি দীর্ঘ দিন চলমান থাকয় ওই এলাকায় বিকল্প কোনো সেচব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ওই এলাকায় কোনো গভীর বা অগভীর নলকূপ নেই। এ ক্ষেত্রে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কুলিং ওয়াটার (ভূউপরিস্থ পানি) ওই এলাকার সেচ সমস্যার সমধান করতে পারে। সে কারণেই প্রকল্পটি তৈরি করা হয়েছে।
আগের প্রকল্পের পঞ্চম ধাপ শেষ হওয়ার পর নতুন প্রকল্প নিতে চার বছর সময় লেগেছে, যে সময়টিতে ওই এলাকায় সেচ বলতে গেলে বন্ধই ছিল। প্রকল্প তৈরিতে এত সময় লেগেছে কেন, সে প্রশ্নও তোলায় পিইসি সভায়।
এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকৌশলী ওবায়েদ বলেন, নতুন প্রকল্প প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়ার পর প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের ড্রইং, ডিজাইন ও লেআউট প্ল্যান সমীক্ষা কার্যক্রমটি সিইজিআইএসের মাধ্যমে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। সেচের পানি পরিবহণে ঢাকা-সিলেট হাইওয়ের সঙ্গে নিজস্ব কোনো জায়গা না থাকায় সড়ক বিভাগের অধিগ্রহণ করা ভূমিতে ছয়-লেন মহাসড়কের ‘রাইট অব ওয়ে’র শেষ প্রান্তে বিএডিসি নতুন ইরিগেশন ক্যানেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি পারস্পরিক সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লেগেছে। ফলে প্রকল্পটি চূড়ান্তভবে প্রণয়ন করতেও দেরি হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত সচিব (সেচ) এনামুল হক সভায় বলেন, আশুগঞ্জ নদীবন্দর-সরাইল-ধরখার-আখাউড়া স্থলবন্দর মহাসড়ককে চার-লেন জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত করতে গিয়ে সেচ প্রকল্প ব্যাহত হয়। আশুগঞ্জ-পলাশ অ্যাগ্রো-ইরিগেশন প্রকল্পের সেচ কার্যক্রম পুনরায় সচল করবে নতুন প্রকল্পটি। এর জন্য ৪৭০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২৮ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য করা হয়েছে।
সভায় বিএডিসির উপপ্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ ওবায়েদ হোসেন জানান, আশুগঞ্জ পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ১১০০ ও ঘোড়াশালের থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ৮০০ কিউসেক পানি শীতল করা যাবে। এই পানি দিয়ে যে পরিমাণ কৃষিজমি সেচের আওতায় আনা যাবে তা থেকে এক লাখ পাঁচ হাজার ৫০ মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, প্রকল্প প্রস্তাবনায় ভূমি অধিগ্রহণের খরচ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে পিইসি সভায়। ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) ক্ষতিপূরণ বাবদ ছয় কোটি ৩০ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছিল। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাবিত জায়গার একটি অংশ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) মালিকানাধীন।
পিইসি সভায় বলা হয়, সরকারি এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে জমির মালিকানা হস্তান্তর হলে কাউকে কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে হয় না। এ ক্ষেত্রেও বিপিডিবির জমির জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। অন্যদিকে জায়গা অধিগ্রহণ বাবদ জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে প্রায় দুই কোটি ৫৬ লাখ টাকার ব্যয় প্রাক্কলন দেওয়া হয়েছে।
বিএডিসি প্রতিনিধি সভায় এ প্রসঙ্গে বলেন, লোকেশন অনুযায়ী প্রস্তাবিত জায়গার দাম অনেক এবং যেকোনো সময় জায়গার দাম বাড়তে পারে। সব মিলিয়ে প্রস্তাবিত জায়গা অধিগ্রহণ বাবদ আগের পিইসি সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডিপিপিতে পাঁচ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন যে সিদ্ধান্ত জানিয়েছে
প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত কুলিং রিজার্ভারের আয়তন সেচ সুবিধা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত কি না এবং পানি উত্তপ্ত হওয়ার কারণে পানির গুণগত মান চাষাবাদের উপযোগী থাকে কি না, তা প্রকল্পের ভূমিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছে পরিকল্পনা কমিশন।
উপজেলা সেচ কমিটি নির্ধারিত সেচ চার্জের হার অনুযায়ী একর প্রতি হার, প্রতি বছর কী পরিমাণ জমিতে সেচ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে এবং গত ১০ বছর এ বাবদ কী পরিমাণ অর্থ আদায় হয়েছে ও কী পরিমাণ বাকি আছে— পরিকল্পনা কমিশন এসব তথ্য ডিপিপিতে সংযুক্ত করতে বলেছে।
এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় ওয়াটারগেজ স্থাপনসহ কুলিং রিজার্ভার পুনর্খনন, সেচ ও নিস্কাশন খাল-নালা খনন বা পুনর্খনন, বক্স টাইপ ক্লোজড কনডুইট নির্মাণ, ২/৩/৪-ভেন্ট রেগুলেটর নির্মাণ, মাঝারি আকারের হাইড্রোলিক স্ট্রাকচার, ছোট আকারের হাইড্রলিক স্ট্রাকচার ও আরসিসি ক্যানেল নির্মাণ ইত্যাদি অঙ্গগুলোও ডিপিপিতে সংযুক্ত করতে বলা হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন