বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এর মধ্যে দিয়ে টানা পৌনে ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ইতিমধ্যে শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। আদালত ১৮ নভেম্বরের মধ্যে তাদের হাজির করার নির্দেশ দিয়েছে।
তবে জুলাই গণহত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ বিদেশে পলাতকদের গ্রেপ্তার করতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ‘রেড নোটিশ’ জারি করা হচ্ছে।
আজ রোববার সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পুরোনো ভবনের সংস্কারকাজ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন (ইন্টারপোল) একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা, যার প্রধান কাজ আন্তর্জাতিক পুলিশকে সহায়তা করা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের কাজ করে থাকে ইন্টারপোল। এর সদর দপ্তর ফ্রান্সের লিয়োঁ শহরে।
ইন্টারপোলের কাছে প্রত্যর্পণ, আত্মসমর্পণ বা অনুরূপ আইনি পদক্ষেপের জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে এবং সাময়িকভাবে গ্রেপ্তার করার জন্য ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি হলে তাকে ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে ছবিসহ দেখানো হবে। সেখানে তার কিছু তথ্য থাকবে। তবে ইন্টারপোল কোনো রেড নোটিশধারী ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারে না।
ইন্টারপোলের ওয়েবসাইট ঘুরে দেখা যায়, বাংলাদেশ সংস্থাটির কাছে চেয়েছে এমন ৪৭ জন এবং বাংলাদেশে জন্ম এমন ৬৪ ব্যক্তিসহ ১৯৫টি সদস্য দেশের ৬ হাজার ৬৬৯ জনের নাম ঝুলছে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ বোর্ডে।
তবে ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে রেড নোটিশে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় সবার নাম থাকলেও অনেকের ছবি নেই। কে কোন জেলার ঠিকানায় তার উল্লেখ নেই। এমনকি কারও কারও পুরো নামও নেই।
অপরাধে করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের নাম ইন্টারপোলে পাঠানো ও তদারকির দায়িত্ব ঢাকার পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)-র।
এই শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন অপরাধ করে বিদেশে পালিয়ে গেছেন এমন ৬৪ ব্যক্তির নাম ও অপরাধের বিস্তারিত তথ্য ইন্টারপোলের কাছে পাঠানো হয়েছে রেড নোটিশ জারির জন্য।
এর মধ্যে রয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা, হত্যা, মাদক ও মানবপাচার, অবৈধ অস্ত্র রাখা, বিস্ফোরক ও বিপজ্জনক অস্ত্র মজুত, টাকা ও স্ট্যাম্প জাল করা, পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা, আওয়ামী লীগের সভায় বোমা হামলা, যুদ্ধাপরাধ, ধর্ষণ, লুটপাট ও গণহত্যাসহ নানা অপরাধে জড়িত ব্যক্তির নাম রয়েছে। এই ৬৪ ব্যক্তির মধ্যে বর্তমানে ইন্টারপোলের রেড নোটিশে ঝুলছে ৬৩ জনের নামে।
রেড নোটিশ জারি হয় কীভাবে : ইন্টারপোল রেড নোটিশ হল একটি আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী নোটিশ, যা ইন্টারপোল কর্তৃক ইস্যু করা হয় এবং এর মাধ্যমে একজন অভিযুক্ত বা দোষী ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে এবং আটক করতে সহায়তা করা হয়।
সাধারণত এমন ক্ষেত্রে এটি ইস্যু করা হয় যখন কোনো ব্যক্তি একটি গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত হন এবং তাকে বিচারের জন্য অন্য কোনো দেশে ফেরত পাঠানোর প্রয়োজন হয়।
রেড নোটিশ একটি বৈধ আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নয়, তবে এটি একটি সহযোগিতামূলক ব্যবস্থা যা সদস্য দেশগুলির পুলিশ বাহিনীকে জানায় যে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বিশ্বের অন্য দেশে পালিয়ে আছেন এবং তাকে খুঁজে বের করা ও আইনগত প্রক্রিয়া চালানোর জন্য সহযোগিতা প্রয়োজন।
ইন্টারপোলের বর্তমান সদস্য দেশ ১৯৪। কারও নামে মামলা থাকলে সদস্য দেশের সরকার ইন্টারপোলে ডকুমেন্ট পাঠালে রেড নোটিশ জারি হতে পারে।
এ ক্ষেত্রে দুই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট বা তথ্যাদি পাঠাতে হয়। যেমন—১। কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে শনাক্ত করার জন্য তাদের নাম, জন্ম তারিখ, জাতীয়তা, চুল এবং চোখের রং, ছবি এবং আঙুলের ছাপ (যদি পাওয়া যায়)। যে অপরাধের জন্য সন্ধান সে সম্পর্কিত তথ্য। সাধারণত খুন, ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন বা সশস্ত্র ডাকাতি হতে পারে।
ইন্টারপোল তাদের ওয়েবসাইটে বলছে, নোটিশ হলো আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অনুরোধ বা সতর্কবার্তা, যা সদস্য দেশগুলোর পুলিশকে অপরাধ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভাগাভাগি করার সুযোগ দেয়।
এই নোটিশ ইস্যু করে ইন্টারপোলের জেনারেল সেক্রেটারিয়েট, যা সদস্য দেশের ইন্টারপোল ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর অনুরোধের ভিত্তিতে তৈরি হয় এবং এটি সদস্য দেশগুলোর জন্য ইন্টারপোলের নোটিশ ডেটাবেসে উপলব্ধ থাকে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের অনুরোধেও নোটিশ ইস্যু হতে পারে, বিশেষত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার লক্ষ্যে।
এ ছাড়াও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের জন্যও জাতিসংঘের অনুরোধে নোটিশ ইস্যু করা যায়। বেশিরভাগ নোটিশ শুধুমাত্র পুলিশের ব্যবহারের জন্য এবং জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। তবে, কোনো দেশ চাইলে নোটিশের একটি সংক্ষিপ্ত অংশ জনসাধারণের জন্য প্রকাশিত হতে পারে, যাতে তাদের সহযোগিতা চাওয়া যায়। জাতিসংঘের স্পেশাল নোটিশসমূহ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে।
রেড নোটিশ জারি হলে কি হয়: যে দেশগুলোর সঙ্গে ইন্টারপোলের সংযোগ আছে, সেসব দেশের পুলিশ বাহিনী রেড নোটিশ প্রাপ্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত এবং আটক করতে উদ্যোগী হতে পারে। এটি কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নয়, তবে অনেক দেশ এটিকে গ্রেপ্তারি নির্দেশ হিসেবে বিবেচনা করে। রেড নোটিশের কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তি আন্তর্জাতিক ভ্রমণ করতে পারেন না, কারণ যে কোনো দেশে প্রবেশের সময় তাকে আটক করা হতে পারে। অনেক দেশ বিমানবন্দরে এই ব্যক্তিকে আটক করতে পারে বা সীমান্তে বাধা প্রদান করতে পারে। গ্রেপ্তার হলে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ অনুযায়ী তার নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।
প্রত্যর্পণের আইন অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট দেশটি তাকে ট্রাইব্যুনাল বা আদালতের সামনে হাজির করতে পারে। ইন্টারপোলের রেড নোটিশের কারণে বিভিন্ন দেশের পুলিশ বাহিনী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্পর্কে তথ্য বিনিময় করতে থাকে এবং তদন্তের ক্ষেত্রেও সহযোগিতা করে।
রেড নোটিশে থাকা ব্যক্তির ব্যাংকিং, ব্যবসা, এবং সামাজিক অবস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অনেক দেশে এ ধরনের নোটিশ পেয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ বা জব্দ করা হয় এবং সরকারি পদ বা দায়িত্ব পালনেও বাধা সৃষ্টি হতে পারে। রেড নোটিশ থাকলে অভিযুক্ত ব্যক্তি অনেক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মঞ্চে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, কারণ বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করা ও আর্থিক লেনদেন চালানো কঠিন হয়ে যায়।
শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারে জারি হচ্ছে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ: আইন উপদেষ্টাশেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারে জারি হচ্ছে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ: আইন উপদেষ্টা
ইন্টারপোলের কত প্রকার নোটিশ
ইন্টারপোলের ৮ প্রকার নোটিশ রয়েছে। এগুলো হল-
রেড নোটিশ: কোনো ব্যক্তিকে বিচারের জন্য বা সাজা খাটানোর উদ্দেশ্যে তার অবস্থান এবং গ্রেপ্তারের জন্য অনুসন্ধান।
ইয়েলো নোটিশ: নিখোঁজ ব্যক্তিদের, বিশেষ করে নাবালকদের খুঁজে পেতে বা যারা নিজেদের পরিচয় দিতে অক্ষম তাদের শনাক্তকরণের জন্য সহায়তা।
ব্লু নোটিশ: কোনো অপরাধ তদন্তের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তির পরিচয়, অবস্থান বা কার্যকলাপ সম্পর্কে অতিরিক্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য।
ব্ল্যাক নোটিশ: অজ্ঞাত মৃতদেহ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য।
গ্রিন নোটিশ: জননিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বিবেচিত ব্যক্তির অপরাধমূলক কার্যকলাপ সম্পর্কে সতর্কতা প্রদানের জন্য।
অরেঞ্জ নোটিশ: এমন কোনো ঘটনা, ব্যক্তি, বস্তু বা প্রক্রিয়া সম্পর্কে সতর্কতা দেওয়ার জন্য, যা জননিরাপত্তার জন্য গুরুতর এবং আসন্ন হুমকি তৈরি করতে পারে।
পার্পল নোটিশ: অপরাধীদের ব্যবহৃত পদ্ধতি, বস্তু, যন্ত্রপাতি এবং লুকানোর পদ্ধতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ বা সরবরাহ করার জন্য।
ইন্টারপোল–জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ বিশেষ নোটিশ: জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞা কমিটির লক্ষ্যবস্তু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের জন্য ইস্যু করা। উৎস: আজকের পত্রিকা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন