নানা অনিয়মের খবর প্রকাশ্যে আসার পর ২০২৩ সালে টাকার সংকটে পড়ে বেসরকারি খাতে পরিচালিত ইসলামী ব্যাংক। পরিস্থিতি সামলাতে ব্যাংকটি আমানত সংগ্রহে কর্মকর্তাদের লক্ষ্য বেঁধে দেয়। পরে সফল সাড়ে ১৩ হাজার কর্মকর্তাকে পুরস্কার হিসেবে স্যুট বানানোর কাপড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। তবে কোনো কর্মকর্তা স্যুটের কাপড় পাননি, তবে ঠিকই খরচ হয়েছে ব্যাংকটির সাড়ে ছয় কোটি টাকা।
একই বছরে ডলার–সংকট মেটাতে প্রবাসী আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় ইসলামী ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে প্রবাসী আয়ের সুবিধাভোগীদের জন্য উপহার হিসেবে এক লাখ ছাতা কেনার সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাংকটি। সেই ছাতা কেউ ব্যাংকে সরবরাহ করেনি। তবে ছাতা কেনার নামে ব্যাংকটি থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা।
কাল্পনিক দুই পণ্য ক্রয়ে কাগজে–কলমে ব্যাংকের ১২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। গত বছরের আগস্ট–অক্টোবর সময়ে এই অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে বলে ইসলামী ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নথিপত্র পর্যালোচনায় করে তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এই টাকার প্রকৃত সুবিধাভোগী কারা, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। স্যুট কেনার অর্থের যাত্রাপথ গোপন করতে চট্টগ্রামের পটিয়ার এক ব্যবসায়ীর হিসাব এক দিনের জন্য ব্যবহার করা হয়। ওই টাকা এক দিনে তিনটি হিসাব ঘুরিয়ে নগদ তুলে নেওয়া হয়। নিজেদের আড়ালে রাখতে এই কৌশল নেয় সুবিধাভোগীরা।
স্যুটের টাকা গেল কোথায়
নিয়মিত ১৩ হাজার ৫২২ কর্মকর্তাকে স্যুটের কাপড় পুরস্কার হিসেবে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় ২০২৩ সালের ২৬ জুলাই ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদের ৩২৮তম সভায়। কার্যাদেশ পায় ব্যাংকটির রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোড শাখার গ্রাহক বেলমন্ট ফেব্রিক্স। গত বছরের ২৯ আগস্ট এই পোশাক তৈরির প্রতিষ্ঠানের নামে কাপড় সরবরাহের চালান ও বিল জমা পড়ে। পণ্য সরবরাহ হয়নি জেনেও একই দিন অর্থ ছাড়ের অনুমতি চান ব্যাংকটির প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা ফরিদ উদ্দিন, তাতে অনুমতি দেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা।
নথিপত্র পরীক্ষা করে দেখা গেছে, পরের দিন ৩০ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে ৬ কোটি ৩৫ লাখ ২৬ হাজার টাকা ছাড় করে ইসলামী ব্যাংক। একই দিন বেলমন্টের এক চেকের মাধ্যমে ৩ কোটি ৩৫ লাখ ২৬ হাজার টাকা এবং আরেক চেকের মাধ্যমে ৩ কোটি টাকা নগদ উত্তোলন করা হয়।
ওই শাখায় বেলমন্টের প্রায় ৫০ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। ঋণের নিরাপত্তা হিসেবে বেলমন্ট শাখায় স্বাক্ষর করা চেক জমা দিয়েছে। ঋণ অনাদায়ি হয়ে পড়লে সাধারণত এই চেক ব্যবহার করে ব্যাংক মামলা করে থাকে। বেলমন্টের দুই নিরাপত্তা চেক ব্যবহার করে ওই টাকা তোলা হয়েছে বলে শাখার একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
বেলমন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ বাদশা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা স্যুট বানানোর কাপড় সরবরাহের কার্যাদেশ পেয়েছিলাম। তবে যত দূর মনে পড়ে, তা সরবরাহ করা হয়নি। ব্যাংকে আমাদের প্রায় ৫০ কোটি টাকা ঋণ আছে। এ জন্য স্বাক্ষর করা চেক জমা দেওয়া আছে। হয়তো সেই চেক ব্যবহার করে আমাদের হিসাবে দেওয়া টাকা আবার তুলে নেওয়া হয়েছে।’
ব্যাংকের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ওই দিনই এলিফ্যান্ট রোড শাখা থেকে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখার গ্রাহক মাসুদ ফিশ প্রসেসিং অ্যান্ড আইসক্রিম লিমিটেডের হিসাবে একবার ৪ কোটি ও আরেকবার ২ কোটি টাকা নগদ জমা করা হয়। সেই টাকা আবার একই দিন খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে তিনটি চেকের মাধ্যমে তুলে নেওয়া হয়। মাসুদ ফিশ প্রসেসিং ব্যাংকটির খাতুনগঞ্জ শাখার পুরোনো গ্রাহক। শাখায় তাদের প্রায় ৫০ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। ফলে তাদের স্বাক্ষর করা চেকও ওই শাখায় জমা দেওয়া আছে।
মাসুদ ফিশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফ হোসেন মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পটিয়ার হলেও এস আলম গ্রুপের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। খাতুনগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক ও দ্বিতীয় কর্মকর্তার অনুরোধে আমার হিসাবটি ব্যবহার করতে দিয়েছিলাম। এখন বুঝতে পারছি আমার হিসাব ও তিনটি চেক ব্যবহার করতে দেওয়াটা ভুল হয়েছে। আমরা ১৯৮৮-৮৯ সাল থেকে ব্যাংকটির গ্রাহক। তবে গত কয়েক বছর ব্যাংকের অসহযোগিতার কারণে ব্যবসা করতে পারিনি। এ জন্য ব্যাংকের চাপে বাধ্য হয়ে হিসাবটি ব্যবহার করতে দিয়েছিলাম।’
স্যুটের টাকা নিয়ে যখন অনিয়ম হয়, তখন ইসলামী ব্যাংক চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। গ্রুপের প্রধান সাইফুল আলমের বাড়ি পটিয়ায়। তাঁর ব্যক্তিগত সচিবসহ চট্টগ্রামের আরও কয়েকজন ব্যাংকটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে ছিলেন। অর্থ ছাড়ে মূলত তাঁদের তৎপরতা ছিল বলে জানিয়েছেন এখনকার কর্মকর্তারা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পর্ষদ ভেঙে ইসলামী ব্যাংক এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা হয়।
ছাতার টাকাও গায়েব
এক লাখ ছাতা কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছিল গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৩২৯তম সভায়। কার্যাদেশ দেওয়া হয় এক্সপ্রেস কমিউনিকেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। মাসখানেক পর ১০ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটির নামে ছাতা সরবরাহের চালান ও বিল জমা পড়ে। ছাতা সরবরাহ না হলেও টাকা ছাড়ের অনুমতি চান প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা ফরিদ উদ্দিন, অনুমতি দেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা। এরপর ব্যাংকটি এক্সপ্রেস কমিউনিকেশনের নামে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার পে অর্ডার ইস্যু করে, যা একই দিন নগদে তুলে নেওয়া হয়। এই টাকার প্রকৃত সুবিধাভোগী কারা, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এক্সপ্রেস কমিউনিকেশনের কর্ণধার দীপক ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবুল খায়ের নামে আমার একজন ব্যবসায়িক পার্টনার ছিলেন। উনি ব্যাংকের উপহার সরবরাহের বিষয়টি দেখেন। তবে ছয়-সাত মাস ধরে তিনি আমাদের সঙ্গে নেই।’ যোগাযোগ করা হলে আবুল খায়ের বলেন, ‘আমি এ নিয়ে কিছুই জানি না।’
এসব বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, এই ব্যাংকে আগামীতে ফরেনসিক তদন্ত হলে এসব অনিয়মের প্রকৃত সুবিধাভোগী কারা ছিল তা বের হয়ে আসবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন