নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার বিশনন্দী ইউনিয়নের মেঘনা নদীর পারে ছোট্ট এক গ্রাম মানিকপুর। এই গ্রামের সিদ্দিকুর রহমান কখনো নদীতে মাছ ধরে, কখনো বা কৃষিকাজ করে সংসার চালাতেন। স্ত্রী আর তিন সন্তান নিয়ে অভাবের ঘর। সন্তানদের মৌলিক চাহিদা মেটাতেই হিমশিম অবস্থা।
তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে কৃষিকাজের যন্ত্রপাতি রেখে সিদ্দিকুর বেরিয়ে পড়েন একটু সচ্ছল জীবনের খোঁজে। ২০১৩ সালের জুনে পা বাড়িয়েছিলেন মালয়েশিয়ার পথে। বিশ্বাস করে তিন লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে ধরেছিলেন ইব্রাহিম নকিব নামের স্থানীয় এক দালালের হাত। কিন্তু নকিব তাঁকে নিয়ে যান এক অনিশ্চিত বিপত্সংকুল পথে।
ছয় মাস পর স্ত্রী বিলকিসকে ফোনে জানিয়েছিলেন, বিমানবন্দরের বদলে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল টেকনাফে, বিমানের বদলে তুলে দেওয়া হয় গরুর ট্রলারে। বিলকিসের সঙ্গে সেটাই ছিল স্বামীর শেষ কথা। তিনি আর স্বামীর সন্ধান পাননি। এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে ১১টি বছর।
আজও স্বামীর পথ চেয়ে আছেন।
সম্প্রতি বিলকিস বেগমের জীবনের এই কঠিন ট্র্যাজেডি শুনতে গেলে আশপাশে আরো কিছু মানুষ জড়ো হয়। মানিকপুর গ্রামের বাসিন্দারা বলছিল, কৃষক সিদ্দিকুর একা নন, তাঁর মতো পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে আরো বহু মানুষকে। আর এই গল্প মানিকপুর ছাড়িয়ে পুরো উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামের। ভাগ্যক্রমে কেউ মালয়েশিয়ায় পৌঁছে যান, অনেকেরই সলিলসমাধি ঘটে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগরে।
আবার অনেকের ঠিকানা মাঝপথে মায়ানমার কিংবা থাইল্যান্ডে দালালদের নিষ্ঠুর টর্চার সেলে।
মানুষ বেচে ওরা কোটিপতিএখানকার আরো কয়েকটি বাড়ি ঘুরে কালের কণ্ঠ জানতে পারে, দালাল নকীবের চক্র জাল পেতে রেখেছে পুরো আড়াইহাজার উপজেলায়। তাঁর দলে আছে অন্তত ৬০ জনের বিশাল মাঠকর্মী। এই মাঠকর্মীদের কাজ হলো গ্রামের অভাবী সহজ-সরল মানুষ বাছাই করা। এরপর চটকদার প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলা। বিনিময়ে মাঠকর্মীদের পকেটও গরম হয়। কালের কণ্ঠ পুরো উপজেলা ঘুরে ৭৯টি পরিবারের সন্ধান পেয়েছে, যাদের পরিবারে একমাত্র কর্মক্ষম পুরুষ মানুষটি সচ্ছল জীবনের খোঁজে বেরিয়ে হারিয়ে গেছেন প্রায় চিরতরে, যাঁদের বিপথে ঠেলে দেওয়ার অন্যতম কুশীলব নকীব।
কালের কণ্ঠ অনুসন্ধানে নামে জানতে যে কে এই নকীব। মানিকপুর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে দিঘলদী গ্রামে নকীবের বাড়ি। বাড়ি তো নয়, সুনসান নিশ্চল গ্রামের ভেতরে আলিশান এক ত্রিতল বাড়ি। স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, এই বাড়িতে গত সাত-আট বছর ধরে কোনো মানুষ থাকে না। দেড় থেকে দুই দশক আগে নকীব ছিলেন তাঁত শ্রমিক। তাঁতকল অধ্যুষিত আড়াইহাজারের শ্রমিকরা এমন বাড়ির মালিক হওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবেন না। অথচ নকীব এমন চার-চারটি বাড়ি গড়েছেন।
দিঘলদী গ্রামে নকীবের একে একে তিনটি বাড়িতে সরেজমিনে গেছেন কালের কণ্ঠ’র প্রতিবেদক। বাকি দুটির একটি দোতলা, আরেকটি তিনতলা। তিনটি বাড়ির কোনোটিতেই কেউ থাকে না। এমনকি ভাড়াও দেওয়া হয় না। ইব্রাহিম নকীবের নামে দিঘলদী মৌজাতেই সন্ধান মেলে আরো প্রায় ১৫ একর জমির। এ ছাড়া ফাউসা বাজারে তাঁর রয়েছে একটি বাণিজ্যিক ভবন, যেখানে রয়েছে তিনটি দোকান। স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, মানুষ বেচার কারবার শুরু করেই যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়ে বদলে গেছে নকীবের জীবন।
অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে মাঠকর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলা দালাল নকীবের সাম্রাজ্যের চেয়ে আরো বড় এক চক্রের সন্ধান পেল কালের কণ্ঠ। এই চক্রের নেতৃত্বে আছেন ঈসমাইল হোসেন। বিশনন্দী গ্রামের ঈসমাইল ২০০১ সালে শ্রমিক হিসেবে মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন। ২০০৫ সালে দেশে ফিরে তিনি গড়ে তোলেন আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইসমাইলের চক্রে মায়ানমার ও মালয়েশিয়ার ১০ থেকে ১২ জন নাগরিক যুক্ত রয়েছেন, যাঁরা আড়াইহাজার থেকে শিকার সংগ্রহ করেন এবং পরে তাদের মায়ানমারে বন্দি করে মুক্তিপণ আদায় করেন। মুক্তিপণ না পেলে অনেক ক্ষেত্রেই বন্দিকে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়। গত আগস্টে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রকাশ্যেই সহযোগীদের নিয়ে মানবপাচার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছিলেন ঈসমাইল। কিন্তু এর পর থেকে তাঁকে আর দেখা যায়নি। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করাও সম্ভব হয়নি। বিশনন্দী গ্রামের যে পৈতৃক বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকতেন ঈসমাইল, সেখানে গিয়ে দেখা যায় সেটি তালাবদ্ধ। কোনো মানুষ সেখানে থাকে না। তারা কোথায় গেছে প্রতিবেশীরাও জানে না।
কালের কণ্ঠ’র দীর্ঘ অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য এবং ভুক্তভোগীদের ভাষ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অনিশ্চিত সমুদ্রপথে নামিয়ে দেওয়ার পর স্থানীয় দালালরা লাপাত্তা হয়ে যায়। কিন্তু অভিবাসীদের ঠেলে দেওয়া হয় মরণপণ এক সংগ্রামে। সাগরে ভাসতে ভাসতে পথের কষ্টে, খাদ্যাভাবে, নির্যাতনে অনেকেই প্রাণ হারান। তাঁদের কঙ্কালসার মৃতদেহ ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয় সমুদ্রে। কেউ বা ধরা পড়েন পথিমধ্যে কোনো দেশে। কিংবা ধরা পড়েন মালয়েশিয়া পুলিশের হাতে। ফলাফল কারাবাস। কেউ বা আন্তর্জাতিক অপহরণ চক্রের খপ্পরে পড়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন কিংবা তাদের হাতেই প্রাণ হারিয়েছেন। ওদিকে বাংলাদেশে থাকা তাঁদের দরিদ্র পরিবার মুক্তিপণের অর্থ জোগাতে গিয়ে হয়েছে সর্বস্বান্ত। কেউ বা মুক্তিপণের টাকা পাই পাই করে বুঝিয়ে দেওয়ার পরও ফেরত পেয়েছেন লাশ।
বাংলাদেশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া—পর পর চারটি সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশ। পরস্পর লাগোয়া চারটি দেশই হয় বঙ্গোপসাগর, নয়তো আন্দামান সাগরের উপকূলবর্তী। এই উপকূলই হচ্ছে পাচারকারীচক্রের রুট, যার শুরু বাংলাদেশের টেকনাফ উপকূলে। শেষ হয় মায়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়া উপকূলে।
পাচারচক্রে ফেঁসে গিয়ে ভাগ্যক্রমে ফিরে আসতে পেরেছেন, এমন অন্তত ৭০ জনের সঙ্গে কথা বলতে সমর্থ হয় কালের কণ্ঠ। তাঁদের তথ্য মতে, আড়াইহাজার থেকে পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে থাইল্যান্ডে নিয়ে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। এ জন্য গড়ে তোলা হয়েছে একাধিক টর্চার সেল। মায়ানমার ও থাইল্যান্ডে এসব টর্চার সেল রয়েছে, যেখানে এখনো অনেক বাংলাদেশি বন্দি থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে একের পর এক গণকবর আবিষ্কার হওয়ার ঘটনা ঘটে। সেই সব গণকবরে পাওয়া গিয়েছিল বহু হতভাগ্য মানুষের কঙ্কাল, দেহাবশেষ। এসব দেহাবশেষ ছিল মায়ানমার ও বাংলাদেশের নাগরিকদের।
মানবপাচার নিয়ে তৎপর বেসরকারি সংস্থাগুলো বলছে, যে উপজেলাটি একসময় বিখ্যাত ছিল দেশি কাপড় উৎপাদনের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র হিসেবে, সেই আড়াইহাজার এখন মানবপাচারের রাজধানী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বেসরকারি সংস্থা ওকাপ জানায়, দেশের ছয়টি জেলায় সবচেয়ে বেশি মানবপাচারের ঘটনা শনাক্ত করা গেছে। এগুলো হচ্ছে : ফরিদপুর, নড়াইল, ঝিনাইদহ, শরীয়তপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ। কিন্তু রাজধানী ঢাকার একেবারে কানের পাশে আড়াইহাজারের মতো উপজেলা দেশে আর কোনোটি নয়।
গরুর ট্রলারে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের অনিশ্চিত যাত্রা
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চৈতনকান্দি গ্রামের ষাটোর্ধ্ব রুস্তম মিয়াও পাচারকারীর খপ্পর থেকে রেহাই পাননি। তাঁকে টেকনাফে নিয়ে একটি বড় জাহাজের সামনে নেওয়া হয়। দালালচক্রের এক সদস্য তখন জানায় যে এই বিশাল জাহাজে করেই তাঁকে মালয়েশিয়া পৌঁছে দেওয়া হবে। সরল মনে রুস্তম তখন মোটামুটি নিশ্চিন্তই হয়েছিলেন। কিন্তু ঘোর ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি তাঁর। যাত্রার দিন অন্য সঙ্গীদের সঙ্গে তাঁকেও তোলা হয় একটি গরুর ট্রলারে।
নিজের বাড়িতে বসে রুস্তম বলেন, ‘বুড়া মানুষ আমি। ভাবছিলাম জাহাজে করে যেতে পারলে কাজ করে খেতে পারব। জাহাজের ছবি দেখিয়েছিল। কিন্তু আমাদের নিয়েছিল গরুর ট্রলারে।’ গরুর ট্রলারে যাত্রা শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত মাঝপথে ধরা পড়ে দেশেই ফিরে আসতে হয়েছিল তাঁকে।
ব্রাহ্মদী ইউনিয়নের স্বপন ভূঁইয়াসহ ৪০ জনকে সমুদ্রগামী ট্রলারে তোলা হয়েছিল ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে। জাহাজ ছাড়ার কয়েক ঘণ্টা পরই মুক্তিপণের দাবিতে তাঁদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। পাচারকারীদের দাবি অনুযায়ী স্বপনের স্ত্রী হাসিনা বেগম দালালদের সরবরাহ করা একটি বিকাশ নম্বরে ৫০ হাজার টাকা পাঠান। এরই মধ্যে স্বপনদের এক সঙ্গীকে মেরে সমুদ্রে লাশ ফেলে দেয় পাচারকারীরা। ট্রলারটি শেষ পর্যন্ত মায়ানমারের কোস্ট গার্ডের হাতে ধরা পড়ায় বেঁচে যান স্বপনসহ অন্যরা।
চৈতনকান্দী গ্রামের বাবু মিয়া ট্রলারে চেপে ভেসে বেড়িয়েছিলেন পাঁচ মাস। এক পর্যায়ে দালালরা তাঁদের ট্রলারসহ ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয় একটি জেলে নৌকা তাঁদের ভাসতে দেখে পুলিশে খবর দিলে থাইল্যান্ডের পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করে।
মানিকপুর গ্রামের আরেক ভুক্তভোগী আল-আমীন। তিনবার বিক্রি হয়ে বহুদিন সাগরে ভেসে মালয়েশিয়ার লঙ্কাউই দ্বীপ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লঙ্কাউইতে মালয়েশিয়ার পুলিশের হাতে ধরা পড়েন।
নকীব ও ঈসমাইল চক্রে শতাধিক মাঠকর্মী
নকীবের অবস্থান নিয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। তথ্য মতে, আড়াইহাজার থানায় ইব্রাহীম নকীবের নামে তিনটি মানবপাচারের মামলা আছে। এসব মামলায় ২০১৩ সালে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তিনি। পরে ছাড়াও পেয়ে যান। সেই থেকে তিনি নিরুদ্দেশ। পুলিশের দাবি, নকীব বিদেশে অবস্থান করছেন।
এলাকাবাসীর বক্তব্য, তিনি মাঝেমধ্যে খুব গোপনে আড়াইহাজার এসে ঘুরে যান। ২০১৩ সালে আড়াইহাজারের যেসব পরিবারের সদস্যরা মালয়েশিয়া উদ্দেশে যাত্রা করে চিরতরে নিখোঁজ হয়ে গেছেন, তাঁদের অন্তত চারটি পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, নকীবই ওই মানবপাচারের ঘটনাগুলোর মূল কুশীলব।
স্থানীয়রা বলছে, নিজে প্রকাশ্যে না এলেও আড়ালে থেকে মানবপাচারের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন নকীব। তাঁর হয়ে আড়াইহাজারে পাচারের জন্য মানুষ সংগ্রহ করার মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করে অন্তত ৬০ জন মানুষ। নকীবের ছোট ভাই ইয়াহিয়া নকীব আড়াইহাজারে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ হিসেবে এলাকায় পরিচিত ছিলেন। তাঁরা দুজনও এখন পলাতক।
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে উঠে এসেছে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা দালালচক্রের বেশ কয়েকজনের নাম। এর মধ্যে আইয়ুব খান, আলম খান, ইমরান, ইয়াকুব, আলাউদ্দীন, সোহাগ, মোবারক, আরিফ ও হায়দার মিয়া নকীবের চক্রের সদস্য। নকীব আগে থেকেই গোপন অবস্থানে থেকে কাজ করে এলেও তাঁর সহযোগীরা এত দিন প্রকাশ্যেই ছিল। তবে ৫ আগস্টের পর তারা সবাই পলাতক। তবে এদের মধ্যে হায়দার মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয় কালের কণ্ঠ। হায়দার নিজেও একসময় কৃষি শ্রমিক ছিলেন। এখন আড়াইহাজারে তিনি তিনটি বাড়িসহ মার্কেট এবং ১০ একর কৃষিজমির মালিক।
মানবপাচারের দালাল হিসেবে কাজ করার কথা স্বীকার করে হায়দার মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দালালি তো সবাই করে। আমার কেন দোষ হবে?’
আগস্টে পটপরিবর্তনের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন ঈসমাইল। গত বছরের আগস্টে আড়াইহাজার থানায় তাঁর নামে মানবপাচার আইনে একটি মামলা হয়। ওই মামলায় ঈসমাইলসহ মোট আটজনের বিরুদ্ধে ২০ থেকে ২৫ জন ব্যক্তিকে বিদেশে পাচারের অভিযোগ আনা হয়। মামলার সূত্র ধরে ঈসমাইলকে তাঁর দুই সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব। সে সময় ব্রিফিংয়ে র্যাব জানিয়েছিল, ২০০৫ সাল থেকে ঈসমাইল মায়ানমারের দুই নাগরিককে সঙ্গে নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক পরিচালনা করছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আড়াইহাজারের মানুষকে ফুসলিয়ে টেকনাফ থেকে নৌকায় তুলে দিত ঈসমাইলের দলের সদস্যরা। সেখান থেকে তাঁদের মায়ানমারের আরাকানে পাঠিয়ে দেওয়া হতো জামাল নামে তাদের এক চক্রের সদস্যের কাছ। মায়ানমারে গোপন ক্যাম্পে জামাল ও তাঁর সহযোগীরা ভুক্তভোগীদের বন্দি করে নির্যাতন চালাত। তারা নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে ঈসমাইলের কাছে পাঠাত। ঈসমাইল সেই ভিডিও ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যদের কাছে পাঠাতেন এবং জনপ্রতি ছয় লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দাবি করতেন। যেসব পরিবার মুক্তিপণ দিতে পারত তাদের সদস্যদের থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমা হয়ে মালয়েশিয়ায় রশিদুল নামে চক্রের অন্য এক সদস্যের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। এভাবে শেষ হতো একেকটি অপহরণ চক্র। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানিয়েছিল র্যাব।
জানা গেছে, ঈসমাইল চক্রের অন্তত ৪০ জন সদস্য মাঠ পর্যায়ের দালাল হিসেবে কাজ করে। বাকি সব দালালের মতো এরাও এখন পলাতক। তবে এই ঈসমাইল চক্রেরও দুজন সদস্যের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের।
তাদের একজন কলাগাছিয়া গ্রামের মজিবুল্লাহ বলেন, ‘মাইনসের উফকার করছি ভাই। ক্ষতি করি নাই। বিদেশ পাডাইছি। গিয়া আমাগো ট্যাকা দিছে। অহন হেরা সুখে আছে।’ আরেকজন তাঁতীপাড়া গ্রামের ইয়াকুব বলেন, ‘দালালি তো খারাপ না। মানুষ পাডাইছি, হেরা আমাগো ট্যাকা দিছে।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, মানব পাচারকারীদের মধ্যে দুজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ডও গড়েছেন। তাঁদের একজন আড়াইহাজার পৌরসভার মেয়র সুন্দর আলী। সুন্দর আলী নিজেই একসময় একটি মানব পাচারকারী চক্রের প্রধান ছিলেন। অবশ্য ২০১৯ সালে পৌর মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনি আর মানব পাচার চক্রের সঙ্গে প্রকাশ্য সম্পর্ক রাখেননি। অন্যদিকে ২০০৯ সালে হাইজাদি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আরেকটি চক্রের প্রধান ছিলেন আলী হোসেন। গত ৫ আগস্টের পর থেকে তাঁদেও এলাকায় প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
‘মানবপাচারের এয়ারপোর্ট’
টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি নৌকা মানবপাচারের কাজে যুক্ত রয়েছে। প্রতি রাতে অন্তত ১০টি নৌকা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিয়ে এখান থেকে ছেড়ে যায়। প্রতিটি নৌকায় ঠাসাঠাসি করে বসানো হয় ৫০ থেকে ৭০ জন মানুষ। অবশ্য গত ৫ আগস্টের পর এই চিত্র বদলে গেছে বলে প্রশাসনসহ একাধিক সূত্র দাবি করেছে।
এর আগে সরেজমিনে গিয়ে ও এলাকাবাসীদের সঙ্গে কথা বলে মোট তিনটি ঘাটের অস্তিত্ব জানা গেছে। এর মধ্যে টেকনাফ সদর ইউনিয়নে রয়েছে তুলাতলী ও লম্বরী ঘাট। আর বাহারছড়া ইউনিয়নে রয়েছে কচ্ছপদিয়া ঘাট। আব্দুল লতিফ নামের টেকনাফের একজন জেলের সঙ্গে কথা হয় কালের কণ্ঠ’র। তিনি বলেন, এই ঘাট তিনটিকে স্থানীয়রা চেনে ‘মানবপাচারের এয়ারপোর্ট’ হিসেবে।
তুলাতলী ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, ১০ থেকে ১২টি জেলে নৌকা ঘাটে বাঁধা। দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ৬০ ফুটের বেশি হবে না। এই নৌকাগুলো গভীর সমুদ্রে যাওয়ার উপযোগী নয়। একজন স্থানীয় যুবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নোঙর করা এই বোটগুলোই গভীর রাতে মালয়েশিয়াগামী লোকজনকে তুলে নিয়ে গভীর সমুদ্রে বড় জাহাজে তুলে দিয়ে আসে।
তুলাতলী ঘাটের দুজন জেলে বলেন, তাঁরা সাগরের কাছাকাছি আরো ছোট নৌকায় করে মাছ ধরে সংসার চালান। আর ঘাটে যে নৌকাগুলো বাঁধা অবস্থায় দেখা গেছে, কালের কণ্ঠ’র প্রতিবেদককে সেগুলো মাছ ধরে না বলে জানান তাঁরা। এগুলো মানুষ পাচার করে। সাগরে এসব নৌকার আনাগোনাই বেশি—বলেন দুই জেলে।
তিনটি ঘাটের কাছেই ঝুপড়ির মতো কিছু ঘর চোখে পড়ে এই প্রতিবেদকের। ঘরগুলো চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে তৈরি। টিনের চাল। কোনো জানালা নেই। যে দুজন জেলের সঙ্গে কথা হয় তাঁরা বলেন, এই ঘরগুলোতেই প্রথমে পাচারের শিকার মানুষদের এনে আটকে রাখা হয়। যখন ঘরগুলোর ভেতরে মানুষ থাকে তখন এগুলোর চারপাশে পাহারা থাকে। এই ঘরগুলো থেকেই তাদের রাতের বেলা তুলে নেওয়া হয় নৌকায়, যে নৌকাগুলোকে একমাত্র তুলনা করা যায় সত্যজিৎ রায়ের লেখা সেই পাপাঙ্গুল ছড়ার ‘ছাঁকনি’র সঙ্গেই।
প্রশাসন কী করছে?
তবে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদনের জন্য সাত মাস ধরে অনুসন্ধান ও মাঠ পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে—মানবপাচার আড়াইহাজারে এত ব্যাপক আকার ধারণ করেছে যে এটা এখন অনেকটা স্বাভাবিক বিষয় এই এলাকার বাসিন্দাদের কাছে। এই মানবপাচারের দালালদের শেকড় সমাজের এত গভীরে প্রথিত যে দিনশেষে এরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। যারা এই পেশার সঙ্গে জড়িত তারা এটাকে কোনো অপরাধ বলে গণ্যও করে না।
আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদুর রহমান অবশ্য কালের কণ্ঠকে বলেছেন, মানব পাচারকারীদের শনাক্তকরণের কাজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে। গ্রামের নিরীহ ও সহজ-সরল যুবকদের স্বপ্ন দেখিয়ে অবৈধভাবে যারা বিদেশে পাচার করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন