রেলমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে চীন সফরে গিয়েছিলেন নুরুল ইসলাম সুজন। সেখানে গিয়ে তিনি অত্যাধুনিক রেলস্টেশন দেখে মুগ্ধ হন। বাংলাদেশেও এমন দৃষ্টিনন্দন রেলস্টেশন নির্মাণের ‘অভিপ্রায়’ ব্যক্ত করেন তিনি। এরপর তার মাথায় বুদ্ধি আসে পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পের আওতায় এমন স্টেশন নির্মাণ করা যেতে পারে। ততদিনে ওই প্রকল্পের আওতায় সব স্টেশনের ডিজাইনের কাজ শেষ। মন্ত্রীর বাসনা পূরণ করতে স্টেশনের ডিজাইন পরিবর্তন ও বিপুল অর্থ অপচয়ের প্রসঙ্গ আসে। নাছোড়বান্দা মন্ত্রী তবু সিদ্ধান্ত দেন ফরিদপুরের ভাঙ্গা জংশন স্টেশনকে চীনের আদলে তৈরি করতে হবে।
নুরুল ইসলাম সুজন তার ইচ্ছা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলেদের যুক্ত করেন। তাদের একজন তৎকালীন সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী (লিটন চৌধুরী) এবং তার ভাই ভাঙ্গা এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন চৌধুরী)। তাদের নিয়ে চলে যান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। উপস্থাপন করা হয় কনসেপচুয়াল ডিজাইন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ওই প্রস্তাবে সম্মতি দেন। উপেক্ষিত রয়ে যায় অপচয়ের বিষয়টি। শুরু হয় চড়া খরচে ভাঙ্গা জংশনের মতো এলাকায় বিলাসবহুল স্টেশন নির্মাণের প্রক্রিয়া। সাধারণত একেকটি স্টেশন নির্মাণে খরচ পড়ে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা। কিন্তু তৎকালীন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের ইচ্ছার খেসারত দিয়ে ১৪২ কোটি টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। সময় লাগছে আরও বেশি। আগামী ২০ নভেম্বরের মধ্যে বা এরপর যে কোনো সময় রেলপথটি ট্রেন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় বাসনা পূরণের ওই ভাঙ্গা জংশন স্টেশন পুরোপুরি চালু হবে আরও পরে; আগামী বছরের এপ্রিলে।
বর্তমানে কারাগারে আছেন ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের আমলের রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। আত্মগোপনে আছেন তৎকালীন সংসদের চিফ হুইপ লিটন চৌধুরী ও তার ভাই
নিক্সন চৌধুরী। এ কারণে সরকারের এই বিপুল অঙ্কের টাকা অপচয়ের ব্যাপারে তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। স্টেশনটি নির্মাণে সাকুল্যে খরচ হতে পারে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা। এ স্টেশনের ডিজাইন বাবদ বাড়তি ১২ কোটি টাকা খরচ হওয়ার টার্গেট ছিল। তবে মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত বৈঠকে আপত্তি উত্থাপিত হওয়ায় পরে মোট খরচের ২ শতাংশ ধরা হয় ডিজাইন বাবদ। সে হিসেবে ডিজাইন সংশোধনেই অন্তত ৩ কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী আমাদের সময়কে জানান, ডিজি হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর ওই স্টেশন পরিদর্শনে গিয়ে প্রথম দেখলাম স্টেশনের অবয়ব। শুধু স্টেশন নয়, স্টেশনসংলগ্ন এক কিলোমিটার ধরে লাগোয়া অনেক ভবন দেখলাম। এসব ভবন তৈরির যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার ব্যবস্থা। এই জায়গায় গিয়ে এত লোক কেন থাকবে তা বোধগম্য হয়নি। তা ছাড়া স্টেশনের সাইজ, ধরন সবকিছুই অবাক হওয়ার মতো। বিপুল অর্থ খরচ হয়েছে আমিও মনে করি। কিন্তু আমি যখন দেখেছি তখন কিছুই করার নেই। নির্মাণকাজসহ আনুষঙ্গিক স্থাপন সব কাজ শেষের দিকে।
পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পের পরিচালক আফজাল হোসেন এ ইস্যুতে বলেন, প্রকল্পের আওতায় ১৪টি স্টেশন করা হয়েছে। ব্যতিক্রম ভাঙ্গা জংশন স্টেশনটি। আমরা যতটুকু জানি তৎকালীন মন্ত্রীর অভিপ্রায়ে এ স্টেশনের ডিজাইন পরিবর্তনের নির্দেশ দেয় রেলপথ মন্ত্রণালয়। এরপর এ নিয়ে বৈঠক হয়। মন্ত্রণালয়ের লিখিত নির্দেশনার পর ডিজাইন সংশোধনসহ যাবতীয় কাজে পরিবর্তন আসে। এটা সত্যি, যাত্রীর তুলনায় এ স্টেশনের আধুনিকায়ন ও সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি মিলবে।
রেলসূত্র জানায়, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেললাইন ও ১৪টি নতুন স্টেশনসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় আইকনিক স্টেশন করা হয়। তিনতলা ভবনের ওই স্টেশনে ব্যতিক্রমধর্মী ছাদ, লিফট, এস্কেলেটর, অন্তত একসঙ্গে এক হাজার মানুষ বসার ব্যবস্থা থাকবে। এ ছাড়া বাণিজ্যিক স্থাপনা রাখা হয়েছে। দুটি (ভাঙ্গা জংশন ও শিবচর) স্টেশনের মাঝখানে এমন কোনো শহর বা উল্লেখ করার মতো কোনো স্থাপনা নেই। অনেকটা মাঠের মাঝখানে বিপুল টাকায় স্টেশনটি নির্মাণ করা হয়েছে। এতে একাধিক প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। এ স্টেশনে বিপুল সংখ্যক যাত্রীর সমাগম ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম নিয়ে সংশয় রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। তা ছাড়া অত্যাধুনিক এ স্থাপনার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জনবল ও ব্যয়ের জোগান দেওয়া কঠিন। ফলে এ ধরনের একটি স্টেশন সেখানে করা রাষ্ট্রের টাকার শ্রাদ্ধ হিসেবেই দেখছেন রেলকর্মীরা। মোটা দাগে দরজা, জানালা, ফায়ার লাইটিং, গ্লাস কার্টেন ওয়াল, লিফট অ্যান্ড এস্কেলেটর, এসি ও ফ্লোর টাইলসের কাজ এখনো বাকি।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি তারিখের রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত নথিতে বলা হয়েছে, মাওয়া-ভাঙ্গা সেকশনে পাঁচটি স্টেশন। মাওয়া, জিনজিরা, শিবচর, ভাঙ্গা ও ভাঙ্গা জংশন। মন্ত্রীর ‘অভিপ্রায়’ মোতাবেক ভাঙ্গা জংশনকে একটি অত্যাধুনিক স্টেশনে রূপান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। রেলওয়ের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিআরইসি ইতোমধ্যে স্টেশনগুলোর কনসেপচুয়াল ডিজাইন প্রস্তুত করেছে। এ সংক্রান্ত বৈঠকে ভাঙ্গা জংশনে একটি করে স্টেশন বিল্ডিং, পাম্প হাউজ, সাবস্টেশন এবং আরডব্লিউ ও সিডব্লিউ ট্যাংকসহ মোট ১৯টি ভবন নির্মাণের আলাপ হয়। ভাঙ্গা স্টেশনে শুধু সিগন্যালিং ইকুইপমেন্টসের জন্য ভবনের কথা বলা হয়েছে। ভাঙ্গা জংশন নির্মাণে ডিটেইল ডিজাইন বাবদ ১২ কোটি টাকা ও শুধু অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ১০০ কোটি টাকার কথা বলা হয় তখন। এ অতিরিক্ত ব্যয় নিয়ে আলোচনার একপর্যায়ে ‘জরুরি ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করবেন’ বলে জানান তখনকার রেলমন্ত্রী সুজন। স্টেশন নির্মাণের শেষ পর্যায়ে এসে এখন দেখা গেছে, ১৩২ কোটি ৬৩ লাখ ২৫ হাজার ১৮২ টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে কেবল অবকাঠামো নির্মাণে।
ঢাকার বাইরের এ স্টেশনে কী পরিমাণ যাত্রী হবে তার ধারণা মিলে কতটি ট্রেন চলবে ওই রুটে। আপাতত ৫টি ট্রেন চলবে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা হয়ে। এর মধ্যে খুলনা, যশোর হয়ে বেনাপোল, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গার কথা আলাপ হয়েছে। কিন্তু ভাঙ্গা স্টেশনে কতজন যাত্রী ওঠানামা করবেন তা নিয়ে সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও একসঙ্গে সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ১০০ জন হতে পারে। অথচ ভিডিও সার্ভেল্যান্স সিস্টেম, এলিভেটরস, কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাসহ সব সুবিধা থাকবে। ঢাকার কমলাপুর স্টেশনেও এ ধরনের সুবিধা পাচ্ছেন না যাত্রীরা। এখানে কোনো একসময় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হবে এবং মাদারীপুরে হবে অলিম্পিক ভিলেজ এসব গল্প দিয়ে স্টেশনটি করার জন্য চাপ দেন তৎকালীন মন্ত্রী সুজন। এ টাকা খরচের তেমন দরকার নেই বলে রেলওয়ের কর্মকর্তারা বোঝানোর চেষ্টা করলেও কানে নেননি একরোখা সুজন। সরকারের টাকা খরচ হবে আপনাদের সমস্যা কী- এমন কথা বলে দপ্তরে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তাকে ধমকও দেন তিনি। সুজনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ ছিল না বলে জানান রেলওয়ের কর্মকর্তারা। পঞ্চগড় স্টেশনের নাম বদলে তিনি রাখেন ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম স্টেশন’। ভাইয়ের নামে স্টেশনের নাম রাখতে গিয়ে জেলার সাধারণ যাত্রীরা এখনও দ্বিধায় পড়েন। টিকিট সংগ্রহে গন্তব্য সার্চ করতে গিয়ে পঞ্চগড় স্টেশনের নাম খুঁজে পান না তারা।
সূত্রমতে পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ১৮ হাজার ২১০ কোটি ১১ লাখ টাকা। বাকি ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া। এ বছরের জুলাইয়ে প্রথম কিস্তির ঋণের টাকা সুদসহ পরিশোধ করতে হয়েছে সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি)। আর দ্বিতীয় কিস্তির টাকা দিতে হবে আগামী জানুয়ারিতে। অথচ এখনও পুরো পথের ট্রেন চলাচল শুরু হয়নি। চলতি মাসের শেষ দিকে ঢাকা-যশোর গোটা পথ চালুর চিন্তা রেলওয়ের।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, বিগত সরকারের আমলে সারাদেশে ৪৮৪টির মধ্যে ১১৬টি স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে ১৪৬টি নতুন স্টেশন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই বিদেশি অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা প্রকল্পের টাকায় হয়েছে। রাজস্ব খাতের প্রকল্প থেকেও কিছু কিছু স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া এ সময়ে ২৩৭টি স্টেশন ভবন মেরামত ও উন্নয়ন করা হয়েছে। কম আগ্রহ ছিল ইঞ্জিন-কোচ কেনায়। কমিশনের কারণেও অবকাঠামোয় আগ্রহ বেশি ছিল মন্ত্রীসহ তখনকার রেলওয়ে শীর্ষব্যক্তিদের।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন