জন্মনিয়ন্ত্রণে আগ্রহী নারীদের সারাদেশে সরকারি খরচে ইনজেকশন (ভায়াল) দেওয়া হয়। এর মধ্যে তিন মাস মেয়াদের ইনজেকশনে বেশ কয়েকটি জেলায় ওষুধের পরিমাণ কম পাওয়া গেছে। শরীরে প্রয়োগ করার পর বিষয়টি মাঠকর্মীদের নজরে আসে। ফলে ইনজেকশন গ্রহণকারী অনেকের এখন অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের।
মানিকগঞ্জ, জামালপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, শেরপুর, নওগাঁসহ বেশ কয়েকটি জেলায় পরিমাণে কম ওষুধ থাকা ভায়াল প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে। সারাদেশে এ ইনজেকশন সরবরাহ করে টেকনো ড্রাগস লিমিটেড। মাঠকর্মীদের লিখিত অভিযোগ পেয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠানটিকে শোকজ করে। এর পর ইনজেকশন প্রয়োগ বন্ধের নির্দেশ ছাড়াও পরিমাণ কম থাকা ভায়ালের গুণগত মান পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে তারা।
প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গর্ভনিরোধ ইনজেকশন খুবই সংবেদনশীল। এতে আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণ করে ওষুধের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়।
টেকনো ড্রাগসের সরবরাহ করা ‘প্রভেরা’ ইনজেকশনে পরিমাণের তুলনায় কম ওষুধ থাকলে, এটিতে গর্ভধারণের ঝুঁকি থেকেই যাবে। যাদের শরীরে প্রয়োগ হয়েছে, তাদের পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন তারা।
জানা যায়, সরকারিভাবে দম্পতিদের মধ্যে পাঁচ ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। ইনজেকশন দেওয়া হয় তিন ও ছয় মাস মেয়াদে। দরিদ্র শ্রেণির নারী এসব সামগ্রীর সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী। প্রতি মাসে ৬ লাখ ৮০ হাজারের বেশি গর্ভনিরোধ সামগ্রী সরকারি পর্যায়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও দীর্ঘদিন মাঠ পর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর চরম সংকট চলছে। ২৫ উপজেলায় জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনো সামগ্রী নেই। ৩২৭ উপজেলায় ইনজেকশনের মজুতও শেষের পথে। এরই মধ্যে এমন ঘটনা সামনে এলো।
অবশ্য সংকট নিরসনে উন্নয়ন বাজেট থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী কেনার জন্য গত বছর নভেম্বরে দরপত্র আহ্বান করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে টেকনো ড্রাগস লিমিটেড প্রভেরা ইনজেকশন সরবরাহের কাজ পায়। দরপত্রের বিপরীতে সরকার ২৭ কোটি ৯৬ লাখ ৬৭ হাজার টাকা ব্যয়ে ৭০ লাখের বেশি ইনজেকশন কেনে।
জন্মনিয়ন্ত্রণ ইনজেকশনে টেকনো ড্রাগসের বিরুদ্ধে শুভঙ্করের ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তাদের অনেক ভায়ালে নির্ধারিত পরিমাণ ওষুধ নেই। নজরে আসার পর যাচাইয়ে জামালপুর সদরে সরবরাহ করা ৭৪০ ভায়াল প্রভেরার মধ্যে ৪১টিতে কম ওষুধ মেলে। একই জেলার মেলান্দহ উপজেলায় ৬৮, জামালপুর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে ১৯ এবং ইসলামপুরে ৭৩ ভায়ালে নির্ধারিত ওষুধ পাওয়া যায়নি। পরে সংশ্লিষ্ট এলাকার কর্মকর্তারা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেন। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ পান। তবে ভায়ালে কতটুকু ওষুধ কম, তা জানা যায়নি।
জামালপুর পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপপরিচালক আলী আমজাদ দপ্তরী সমকালকে জানান, দুই মাস আগে জেলার ১৪ উপজেলার জন্য আসে ২০ হাজার প্রভেরা ইনজেকশন। ১০ হাজার প্রয়োগ করার পর গত মাসে ভায়ালে পরিমাণে কম ওষুধ টের পান স্বাস্থ্যকর্মীরা। পরে সেসব ভায়াল সংগ্রহ করে অধিদপ্তরে পাঠানো হয়।
একই চিত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ আরও কয়েকটি জেলার। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ কামাল হোসেন সমকালকে জানান, তারা টেকনো ড্রাগসের ইনজেকশন গত দুই মাস ধরে পাচ্ছেন। এক মাস আগে মাঠ পর্যায় থেকে ভায়ালে কম ওষুধ থাকার অভিযোগ আসে। গত ১৫ দিন ধরে এ অভিযোগ বেশি মিলছে। ঢাকা অফিসকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। আগে কখনও এমন হয়নি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রভেরার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। তবে কম ওষুধের ইনজেকশন প্রয়োগে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের ঝুঁকি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মাত্র দুই সপ্তাহ বিষয়টি নজরে এসেছে। এখন পর্যন্ত কেউ অভিযোগ করেনি। আরও কয়েক সপ্তাহ গেলে স্পষ্ট হওয়া যাবে। তবে সারাদেশে একই ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়েছে। ফলে গর্ভধারণের আশঙ্কা থেকেই যায়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, ১০ বছর ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সরবরাহ করছে টেকনো ড্রাগস। আগে যাচাই-বাছাই করা হয়নি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রথম অভিযোগ আমলে নিয়ে যাচাইয়ে পরিমাণে কম থাকার সত্যতা মিলেছে।
অধিদপ্তরের উপকরণ ও সরবরাহ ইউনিটের পরিচালক মার্জিয়া হক সমকালকে বলেন, ‘অভিযোগ পেয়ে টেকনো ড্রাগসকে তলব করা হয়। তারা এসে জরুরি বৈঠকে ভুল স্বীকার করেছে। ত্রুটিপূর্ণ ভায়াল মাঠ পর্যায় থেকে তুলে নেওয়ার পাশাপাশি নতুন করে সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।’
পরিমাণে কম ওষুধের ভায়াল প্রয়োগের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি ও প্রসূতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. ফারজানা শারমিন শুভ্রা বলেন, পরিবার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নারীদের ইনজেকশন পদ্ধতি গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। তুলনামূলক সুবিধাজনক হওয়ায় আগ্রহ বেড়েছে। এখন ইনজেকশন নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ হলে নারীরা বিপদে পড়বেন। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী গর্ভনিরোধ ইনজেকশনে নির্দিষ্ট পরিমাণ ওষুধ থাকে। টেকনো ড্রাগসের ইনজেকশনে পরিমাণ রক্ষা না হলে এবং যারা এটি নিয়েছেন, তারা সত্যিই ঝুঁকিতে থাকবেন। বড় সংকট হলো– এই ইনজেকশন তিন থেকে ছয় মাসের সুরক্ষা নিশ্চিত করে। এ সময়ে নতুন কোনো গর্ভনিরোধ ইনজেশন নেওয়া যায় না।
টেকনো ড্রাগসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহজালাল উদ্দিন আহমেদের নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ হয়নি।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাইফুল্লাহিল আজম সমকালকে বলেন, ‘লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্ত চলছে। ওষুধ কম থাকা ভায়াল প্রয়োগ বন্ধে মাঠ পর্যায়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘গুণগত মান যাচাইয়ে ত্রুটিপূর্ণ ভায়ালগুলো ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। প্রয়োগের ফলে সমস্যা হতে পারে– প্রতিবেদনে এমন কিছু পেলে টেকনো ড্রাগসের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন