চট্টগ্রাম নগরের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের টোল কমাতে চায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নতুন প্রশাসন। গত সরকারের সময়ে যে টোল মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছিল, তা সংশোধন করাতে চাচ্ছে তারা। ইতিমধ্যে টোলের হার পুননির্ধারণের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তবে আগে যেখানে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে সিএনজি অটোরিকশা, মোটরইসাইকেলের মতো যানবাহন চলাচল করতে না দেওয়া কথা ছিল, সেখানে নতুন প্রস্তাবে এসব গাড়ি চলাচলের কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যানবাহন পরীক্ষামূলক চলাচল করলেও নেওয়া হচ্ছে না টোল।
বৃহস্পতিবার (০৭ নভেম্বর) বাংলা ট্রিবিউনকে এসব তথ্য জানিয়েছেন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘গত ২৮ আগস্ট থেকে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে পরীক্ষামূলক যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে যানবাহন থেকে কোনও টোল আদায় করা হচ্ছে না। আগে যে টোল মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছিল, তা থেকে কমিয়ে পুনরায় নির্ধারণের জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। নতুন টোলের বিষয়টি অনুমোদন হওয়ার পর টোল আদায়ের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হবে। এরপর যানবাহন থেকে টোল আদায় কার্যক্রম শুরু হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ৯টি র্যাম্পের কাজ চলমান আছে। ৯টির কাজ দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছি আমরা।’
চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে-২
ইতিমধ্যে টোলের হার পুননির্ধারণের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে
সিডিএ জানায়, মূল অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ হলেও নিরাপত্তা ও সুরক্ষার কিছু কাজ এখনও বাকি রয়ে গেছে। সংস্থাটির পরিকল্পনা ঘাটতির কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত বছরের ১৪ নভেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারা দেশে ১৫৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে ভার্চ্যুয়ালি চট্টগ্রাম নগরের ‘মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী-সিডিএ এক্সপ্রেসওয়ে’-এর উদ্বোধন করেছিলেন।
সিডিএ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরমুখী এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দৈর্ঘ্য ১৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার হওয়ার কথা ছিল। বর্তমানে তা ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার। প্রাথমিক সমীক্ষায় ২০টি র্যাম্প (যানবাহন ওঠানামার পথ) নির্মাণ করার কথা থাকলেও করা হয়েছে ১৪টি। এর থেকে আরও চার-পাঁচটি অপ্রয়োজনীয় র্যাম্প কমানোর চিন্তা করছে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। র্যাম্পের মোট দৈর্ঘ্য ১২ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে আছে মাত্র অর্ধেক। চালুর আগে এত পরিবর্তনের কারণে বেড়ে গেছে ব্যয়ও। সিডিএর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ও চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান র্যাঙ্কিন।
আগের টোল হার
গত ১২ ফেব্রুয়ারি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। সেখানে মোটরসাইকেল, ট্রেইলার ও সিএনজি অটোরিকশা এই তিন ধরনের গাড়ি বাদ দিয়ে টোল চূড়ান্ত করা হয়। ওই সময় প্রাইভেটকারের টোল ১০০, জিপ ১০০, মাইক্রোবাস ১০০, মিনিবাস ২০০, বাস ৩০০, ট্রাক (চার চাকা) ২০০ টাকা ও কাভার্ডভ্যানের জন্য ৫০০ টাকা করে টোল নির্ধারণ করে অনুমোদ দেয় মন্ত্রণালায়।
চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে-1
বর্তমানে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যানবাহন পরীক্ষামূলক চলাচল করলেও নেওয়া হচ্ছে না টোল
তখন এই টোলের হার বেশি দাবি করে নগরবাসীর মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। টোল কমানোর পাশাপাশি মোটরসাইকেল এবং সিএনজি অটোরিকশা চলাচলের সুযোগ দেওয়ার দাবি জানানো হয়।
গত ২ সেপ্টেম্বর আগের সিডিএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনূসের নিয়োগ বাতিল করা হয়। সেখানে প্রকৌশলী নুরুল করিমকে নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর গত ২৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় নতুন টোল হার নির্ধারণের জন্য পুনরায় মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়।
সিডিএর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগের প্রস্তাবে শুধু এক জায়গায় অর্থাৎ লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এটির টোল হার নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে নতুন প্রস্তাবে তিনটি জায়গায় ওঠানামায় টোল আদায়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। এমনকি নতুন প্রস্তাবে ১২টি যানবাহনের আলাদা টোল হার নির্ধারণ করা হয়েছে।
নতুন প্রস্তাবিত টোল
নতুন টোল হারের প্রস্তাবনায় বলা হয়, জিইসি, সিআরবি, আগ্রাবাদ থেকে এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে সিইপিজেড, সিমেন্ট ক্রসিং, কেইপিজেড, সি-বিচে নামা গাড়িগুলোর ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল ১৫, অটোরিকশা (তিন চাকা) ৩০, প্রাইভেটকার ৮০, জিপ ১০০, মাইক্রোবাস ১০০, পিকআপ ১৫০, মিনিবাস ২০০, বাস ২৮০, ট্রাক (চার চাকা) ২০০, ট্রাক (ছয় চাকা) ৩০০, কাভার্ডভ্যান ৪৫০ এবং ট্রেইলার ৪৫০ টাকা। তবে ট্রেইলারের টোল নির্ধারণ করা হলেও ওঠানামা নিষেধ রাখা আছে।
সি-বিচ, কেইপিজেড, সিইপিজেড থেকে এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে নিমতলা, আগ্রাবাদ, টাইগারপাস, লালখানবাজারে নামা গাড়িগুলোর টোলহার মোটরসাইকেল ১৫, অটোরিকশা ৩০, প্রাইভেটকার ৮০, জিপ ১০০, মাইক্রোবাস ১০০, পিকআপ ১৫০, মিনিবাস ২০০, বাস ২৮০, ট্রাক (চার চাকা) ২০০, ট্রাক (ছয় চাকা) ৩০০ ও কাভার্ডভ্যান ৪৫০ টাকা।
চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে-৪
চট্টগ্রাম নগরের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
অপরদিকে, নগরের জিইসি, টাইগারপাস থেকে এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে আগ্রাবাদ, ফকিরহাট নামা গাড়িগুলোর টোল মোটরসাইকেল ১০, অটোরিকশা ২০, প্রাইভেটকার ৫০, জিপ ৭০, মাইক্রোবাস ৯০, পিকআপ ১৩০, মিনিবাস ১৮০, বাস ২৫০, ট্রাক (চার চাকা) ১৮০, ট্রাক (ছয় চাকা) ৩০০, কাভার্ডভ্যান ৪৫০ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বেড়েছে সময় ও প্রকল্প ব্যয়
এক্সপ্রেসওয়ে চালুর কথা ছিল ২০২০ সালের জুনে। পরে তা পরিবর্তন করে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে আরও এক বছর সময় বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই গত বছরের ১৪ নভেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এর উদ্বোধন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এত বছরেও নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় এর সুফল পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৭ সালে একনেকে প্রকল্পটি অনুমোদন হওয়ার সময় তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার সময় নির্ধারণ করা হয়। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে নির্মাণকাজের উদ্বোধন হলেও ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০২২ সালে নকশা সংশোধন করে আরও এক হাজার ৪৮ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এরপরও কাজ শেষ না হওয়ায় সর্বশেষ প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ পুরো শেষ করা যাবে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন