চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম তালুকদার। ২০০৫ সালেও উপজেলার রানীরহাট বাজারে তার একটি সিমেন্টের দোকান ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর ১৫ বছরে সেই তিনিই অন্তত দুইশ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ওই এলাকার সংসদ-সদস্য ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। তার দাপট দেখিয়ে ওই সম্পদ গড়েন তিনি। নিজ ছাড়া স্ত্রীর নামেও কিনেছেন জমি, গড়েছেন ভবন। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় হয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। মাদ্রাসার এতিমদের টাকাও আত্মসাৎ করেছেন তিনি।
স্থানীয়দের তথ্য মতে, শামসুল আলম রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ১নং রাজানগর ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের মধ্য ঘাগড়া এলাকার বাসিন্দা। তার বাবা লালু মিয়া ছিলেন ধানের কলের মিস্ত্রি। রানীরহাট বাজারে শামসুল আলম যে দোকানে খোলা সিমেন্ট বিক্রি করতেন সেখানে তার বাবাও সময় দিতেন। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ড. হাছান মাহমুদের ছত্রছায়ায় শামসুল আলম হয়ে যান রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসম্পাদক। একপর্যায়ে হন সাধারণ সম্পাদক। রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় হাছান মাহমুদের পরেই ছিল শামসুল আলমের অবস্থান।
রানীরহাট বাজারের ব্যবসায়ী দিদার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সর্বেসর্বা ছিলেন শামসুল আলম। সেখানকার নৈতিক-অনৈতিক সব কিছুতেই তার কাছ থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হতো। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের পুকুর কাটার টেন্ডার থেকেও তাকে কমিশন দিতে হয়েছে। এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদের নির্দেশনা ছিল।’
দিদার উদ্দিন আরও বলেন, ‘শামসুল আলমের প্রকাশ্যে ছিল ঠিকাদারি ব্যবসা এবং গোপনে ছিল মাদকের। এলজিইডিতে মেসার্স এস আলম ট্রেডার্স নামে তার একটি ঠিকাদারি লাইসেন্স রয়েছে। সেই লাইসেন্স দিয়ে বৈধ কাজগুলো করলেও কাজ না করে প্রকল্পের টাকা তুলে নেওয়ার জন্য ভিন্ন ভিন্ন লাইসেন্স ব্যবহার করতেন তিনি। এ ছাড়া সরকারি যে কোনো প্রকল্পের কাজে তাকে কমিশন দিয়ে কাজ নিতে হতো। সরকারি নিয়োগ, পদোন্নতি, বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ, সিএনজি (অটোরিকশা) স্ট্যান্ড থেকে টাকা উত্তোলন, সিএনজি সমিতি, গাছের ও মালবাহী ট্রাকসহ সব ধরনের পরিবহণ থেকে চাঁদা আদায় হতো তার মাধ্যমে। তিনজনের সিন্ডিকেটে এলাকায় মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করতেন শামসুল। তার প্রধান এজেন্ট ছিল ইসলামপুর এলাকার তৌহিদ চৌধুরী এবং অপরজন ছিলেন লালানগর এলাকার মহিউদ্দিন তালুকদার। তাদের মাধ্যমে এলাকায় মদ, গাঁজা ও ইয়াবা বেচা-বিক্রি চলত। সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছিলেন, উপজেলার ভালো-খারাপ সব কিছু শামসুল দেখবে। তাই পার্টির খরচ জোগানোর কথা বলে বৈধ-অবৈধসহ সব ধরনের কর্মকাণ্ডের হোতা ছিল শামসুল আলম।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শামসুল আলম ২০১৬ সালে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১নং রাজানগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর তিনি রানীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা ও এতিমখানার সভাপতি পদ নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু করেন। অনুগতদের নিয়ে পরিচালনা পরিষদ গঠন করে মাদ্রাসার নামে বরাদ্দ রহম আলী গরুর বাজার থেকে বছরে অন্তত অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। নিয়ম অনুযায়ী গরুর বাজার থেকে আদায় করা টাকার তিন ভাগের দুই অংশ মাদ্রাসা ফান্ডে জমা দেওয়ার কথা। তবে সামান্য কিছু টাকা জমা দিয়ে বাকি টাকা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নজরুল ইসলামসহ ভাগ করে নিয়েছেন। ওই মাদ্রাসার এতিমখানায় ১৮ জন এতিম থাকলেও সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ১০৫ জনের ভাতা নিতেন শামসুল আলম ও অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম। এ ছাড়া মাদ্রাসার টাকায় নির্মিত ভবন সরকারি বরাদ্দ থেকে খরচ হয়েছে বলে নিজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ উত্তোলন করেছিলেন শামসুল। মাদ্রাসার নামে দান করা জমির মাটি বিক্রি করেও অন্তত ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। রানীরহাট ডিগ্রি কলেজের পদ দখল করেও নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন তিনি। এ নিয়ে ৮ সেপ্টেম্বর রানীরহাট বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির এক সদস্য দুদকের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী সদস্য এবং সাবেক চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মঞ্জুরুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমি ২০১১ ও ২০১৬ সালে রাজানগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ছিলাম। দুটি নির্বাচনেই শামসুল আলম আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। এর মধ্যে ২০১১ সালে আমি ছয়টি সেন্টারে বিপুল ভোট পাওয়ায় সাবেক মন্ত্রীর মাধ্যমে তিনটি সেন্টার শামসুল আলম দখল করে নেন। মাঝখানে জামাল উদ্দিন মোস্তফা জাহাঙ্গীর নির্বাচিত হয়ে যায়। পরের বার (২০১৬) মন্ত্রীর চাপে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিলাম। ২০২১-এ ফরম জমা দিতেই পারিনি।’
মঞ্জুরুল হক আরও বলেন, ‘একসময় এক শার্ট ও এক প্যান্ট পরা শামসুল আলম ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের ও তার স্ত্রীর নামে গত ১৫ বছরে দুইশ’ কোটি টাকার সাম্র্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। অবৈধভাবে আয় করা টাকা দিয়ে তার স্ত্রীর নামে অনেক জমি কিনেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জঙ্গল বগাবিলী মৌজায় প্রায় ২৫ একর কৃষি জমি, ১০ একর পাহাড়, যার বাজার মূল্য ১০ কোটি টাকা। মধ্যম ঘাগড়া মৌজায় রয়েছে ১১ একর জমি, যার আনুমানিক মূল্য ৩৫ কোটি টাকা। উত্তর ঘাগড়া মৌজা ও ঠান্ডাছড়ি মৌজাসহ কাউখালী উপজেলায় রয়েছে প্রায় ৭০ একর জায়গা, যার বাজার মূল্য ৪০ কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া শামসুল আলমের চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ থানার পাশে সাত কাঠা জায়গার ওপর ১১ তলা ভবন রয়েছে। কাতালগঞ্জ এলাকায় দুটি সাত তলা ভবন, খুলশী এলাকায় ছয় তলা ভবনসহ রানীরহাট বাজারের খাসজমি দখল করে অত্যাধুনিক মার্কেট ও নিজ এলাকায় বাড়ি নির্মাণ করেছেন তিনি।’ দুদকে জমা দেওয়া একটি অভিযোগেও এসব সম্পদের তথ্য রয়েছে।
রানীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা এলাকার বাসিন্দা আবু শাহাদাত চৌধুরী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা শামসুল আলম ও মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম ভাগ-বাটোয়ারা করে দীর্ঘদিন এতিমখানার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়া মাদ্রাসার নামে সম্পত্তি মঘাছড়ি এলাকায় অন্তত ১০ কোটি টাকার মাটি কেটে বিক্রি করেছেন তারা। মাদ্রাসার আয়-ব্যয় ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যাচাই করলে আরও চাঞ্চল্যকর অনেক ঘটনা বেরিয়ে আসবে। শামসুল আলমের নামে এখনো ইছামতি খাল থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন কাজ চললেও নীরব ভূমিকা পালন করছে প্রশাসন।’
শামসুল আলমের হয়রানির শিকার ভুক্তভোগী মো. আইয়ুব বলেন, ‘আমার ভাই মো. ইলিয়াছ রানীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া মাদ্রাসার চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। আমি বিএনপি করি বলে আমার ভাইকে জোর করে মাদ্রাসা থেকে বের করে দিতে চেয়েছিল শামসুল ইসলাম ও তার অনুগত অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম। প্রতিবাদ করায় শামসুল আলমের কথায় ৩০ জুলাই বিস্ফোরক মামলায় আমাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ছাড়া আমার ভাই পদত্যাগ না করায় তাকে অনেক মারধর করা হয়। তার মাথায় আঘাত করায় তিনি এখন মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এ ঘটনায় ২৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করা হয়েছে।’
মো. আইয়ুব আরও বলেন, ‘অধ্যক্ষ নজরুল ইসলামের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে কথা বললেই মাদ্রাসা থেকে শিক্ষকদের জোর করে বের করা হতো। এর আগে হাফেজ কবির নামে এক শিক্ষকের ৫ বছর চাকরি থাকাবস্থায় তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন তারা। তাদের অত্যাচারে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন মাওলানা হোসেনসহ মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষক।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে শামসুল আলম পলাতক রয়েছেন। মোবাইল নম্বরও বন্ধ থাকায় এসব বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে অভিযোগের বিষয়ে রানীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে এতিমদের জন্য যে টাকা দেওয়া হয় সেই টাকা নির্দিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হয়। এ ছাড়া গরু বাজার থেকে পাওয়া আয়ের টাকাও ব্যাংকে জমা রয়েছে। মাদ্রাসার একটি টাকাও নয়ছয় হয়নি। ইলিয়াছ নামে মাদ্রাসা কর্মচারীকে মারধরের অভিযোগও মিথ্যা। ওই কর্মচারী আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করায় ঘটনাস্থলে থাকা মাদ্রাসার শিক্ষক আবুল কালাম বয়ানি তাকে মারধর করেছে। দলীয় কারণে আমার ওপর এ ধরনের অভিযোগ করা হচ্ছে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন