উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়িয়ে চলছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংক ঋণের সুদহার ক্রমশ বাড়ছে। ইতোমধ্যে সুদের হার প্রায় ১৬ শতাংশে উঠেছে। গত দেড় বছরের কম সময়ে সুদহার বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। এতে ছোট-বড় সব খাতের ব্যবসায়ীর মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। কারণ সুদের হার বৃদ্ধি মানে ঋণের কিস্তির অঙ্কও বাড়া। এমনিতেই ডলার ও গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটসহ নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শিল্পোৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য কমে গেছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় নতুন বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণে আস্থা পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় ক্রমাগত সুদহার বৃদ্ধিতে নিদারুণ চাপে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। সব মিলিয়ে এরই মধ্যে কমে গেছে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা। বেসরকারি ঋণে চলছে ধীরগতি, বিনিয়োগে নেমে এসেছে এক প্রকার স্থবিরতা। এর প্রভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের উচ্চমূল্য ও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে এমনিতেই ব্যবসার খরচ বেড়েছে। এ ছাড়া গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে গত আগস্ট-সেপ্টেম্বর টানা দুই মাস সাভার, আশুলিয়া, টঙ্গী ও গাজীপুরের পুরো শিল্পাঞ্চলে চরম অস্থিরতা ছিল। এর মধ্যেই দফায় দফায় সুদের হার বৃদ্ধি সংকট আরও বাড়িয়ে তুলছে। এভাবে সুদহার বাড়তে থাকলে অনেকের পক্ষে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়বে। অন্যদিকে বিনিয়োগ কমে শিল্পায়নও বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়বে।
এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, বর্তমানে সুদের হার যে পর্যায়ে উঠেছে তাতে ব্যবসা করে মুনাফা করা সম্ভব নয়। উচ্চ সুদের কারণে ব্যবসার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমছে ব্যবসায়ীদের। আবার ঋণ ফেরত দেওয়ার সক্ষমতাও কমছে। কারণ আমাদের সুদসহ ঋণ ফেরত দিতে হয়। তিন মাস পর পর এটা চক্রবৃদ্ধি হয়। ফলে সুদের হার যত বাড়বে, ব্যবসায়ীদের ঋণ ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা তত কমে যাবে। দেখা যাবে সময়মতো অনেকে ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না, এক সময় খেলাপি হয়ে যাবে। আর খেলাপি হলে অন্য ব্যাংকও ঋণ দেবে না। সব মিলে ব্যবসায়ীদের বিপদ বাড়ছে।
বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে ২০২০ সালের এপ্রিলে ব্যাংক ঋণের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশ বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে মেয়াদি আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ বেঁধে দেওয়া হয়। এরপর দীর্ঘ তিন বছরের বেশি সময় ধরে ঋণ ও আমানতের সুদহার এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতি নানা সংকটে পড়লে গত বছরের জুলাই থেকে স্মার্ট পদ্ধতির আওতায় সুদের হার বাড়াতে শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণে চলতি বছরের মে মাসে সুদের হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির আওতায় নীতি সুদহার কয়েক দফা বাড়ানো হয়। এতে ব্যাংক ঋণের সুদহার ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং গত মাসে তা প্রায় ১৬ শতাংশে উঠেছে।
সর্বশেষ গত ২২ অক্টোবর নীতি সুদহার ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা ২৭ অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়েছে। এতে সব ধরনের ঋণের সুদের হার চলতি মাসে আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম আমাদের সময়কে বলেন, সুদের হার যেভাবে বাড়ছে তাতে নতুন বিনিয়োগে কেউ আর সাহস করবে না। বরং বর্তমানে যে বিনিয়োগ আছে সেটাই হুমকির মুখে পড়ে গেছে। সবাই এখন কিভাবে টিকে থাকা যায় সেই চিন্তায় আছে। ব্যবসায়ীদের এখন হাঁসফাঁস অবস্থা। শুধু সুদের হার বাড়ল তা নয়, ঋণের কিস্তি পরিশোধের সার্কুলারে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাতে আগামী বছরের মার্চের পর থেকে একটা কিস্তি পরিশোধে কেউ ব্যর্থ হলেই ঋণখেলাপিতে পরিণত হবে। অর্থাৎ ব্যবসায়ীদের গলাটিপে হত্যা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাজেই ব্যবসা ও ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে যত দ্রুত সম্ভব ঋণের সুদহার কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান আমাদের সময়কে বলেন, সুদের হার বৃদ্ধির বিষয়টি ব্যবসায়ীদের জন্য অবশ্যই বড় উদ্বেগের জায়গা। কোনো ব্যবসায়ী উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতে চাইবে না, অনেকের পক্ষে ব্যবসা করাও সম্ভব নয়। তবে এটাও দেখতে হবে এই পরিস্থিতিতে আমরা আসলাম কিভাবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আগের সরকার তথা অতীতে যদি সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া যেত, সঠিক সময় যদি সুদের হার বৃদ্ধি করা হতো, তাহলে এখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসলে সুদের হার কমানোর সুযোগ ছিল। আমার মনে হয় ইতোমধ্যে সুদের হার যেটা বাড়ানো হয়েছে, এর সঙ্গে অন্য আনুষঙ্গিক পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তাহলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং তখন সুদের হারও কমানো সম্ভব হবে।
শিল্প উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী : বৈশ্বিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিদায়ী অর্থবছরে শিল্প উৎপাদনে তলানিতে নেমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের শিল্প উৎপাদনে যেখানে ৮.৩৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল, সেখানে গত অর্থবছরে হয়েছে মাত্র ৬.৬৬ শতাংশ। তার আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে শিল্পোৎপাদনে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। শুধু শিল্পোৎপাদনই নয়, কৃষি উৎপাদনেও প্রবৃদ্ধি কমছে। গত অর্থবছরে কৃষি উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ২১ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। চলমান পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরে শিল্প ও কৃষি উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি আরও কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নতুন বিনিয়োগ থমকে গেছে : দেশে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানির চিত্র ও বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি থেকে নতুন বিনিয়োগ পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা কমেছে প্রায় ৪১ শতাংশ। একই সময়ে এর এলসি নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। অন্যদিকে গত আগস্ট শেষে বেসরকারি খাতের ঋণের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি গত তিন মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। চলতি অর্থবছরের জুলাইতে বেসরকারি ঋণের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশের ওপরে।
জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বড় প্রভাবের আশঙ্কা : ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে ধীরগতি আসায় চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বড় প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। তবে ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক তাদের পূর্বাভাসে জানিয়েছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৪ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে। আর আইএমএফ বলেছে, প্রবৃদ্ধির হার হবে সাড়ে ৪ শতাংশ। সাময়িক হিসাবে গত অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বৃদ্ধির সুফল মিলছে কম : অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তিন দফা নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। এর প্রভাবে ব্যাংক ঋণের সুদের হার প্রায় ১৬ শতাংশে উঠেছে। এতে গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি কমলেও তা এখনও প্রায় দুই অঙ্কের কাছাকাছি রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ। আর খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। আগের মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্যে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ ও খাদ্য বহির্ভূত খাতে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ছিল। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু সুদহার না বাড়িয়ে বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করাসহ অন্য বিষয়গুলোতে সরকারের মনোযোগ দেওয়া উচিত।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন