আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলোর ভাষ্য, খুলনায় সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের ভাগনে শেখ আরিফুজ্জামান রূপম (৩৪) গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে। তবে রূপমের বাড়ির আশপাশের বাসিন্দারা বলছেন, কোনো ধরনের গণপিটুনি, মারামারি বা গোলযোগের ঘটনা ঘটার কথা জানেন না তারা।
এ ব্যাপারে দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর আতাহার আলী জানান, মারা যাওয়ার পর তারা ঘটনা জানতে পারেন। হাসপাতালের মৃত্যু সনদে ‘পাবলিক অ্যাসল্ট’ লেখা আছে। তবে লাশের সুরতহাল হয়েছে, ময়নাতদন্ত চলছে। তদন্তে সব বিষয় স্পষ্ট হবে। এখনো পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় কোনো মামলা হয়নি। পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা না হলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে। ইতোমধ্যে একটি সাধারণ ডাইরি হয়েছে বলে তিনি জানান।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রের বক্তব্য অনুযায়ী, গত সোমবার ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত খুলনা নগরের দৌলতপুরের আঞ্জুমান রোড এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়। এ সময় আরিফুজ্জামান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি টের পেয়ে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন স্থানীয় লোকজন তাকে ধরে পিটুনি দেন। পরে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে মহানগরীর দৌলতপুর (৫ নম্বর ওয়ার্ডে) আঞ্জুমান মসজিদ সড়কের আমতলা মোড়ে রূপমদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, চারতলা বাড়ির সামনে অনেক মানুষের ভিড়। ওই বাড়িতে রূপমের মা, বাবা, দুই ভাই, এক বোন ও স্ত্রী থাকেন। লাশ তখনো বাড়িতে এসে পৌঁছায়নি। নিচতলায় বসে ছিলেন রূপমের বাবা। তবে তিনি কোনো কথা বলতে চাননি।
বাড়ির সামনে কথা হয় রূপমের ছোট চাচা মো. ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে। রূপমের বাড়ির পাশেই ফরহাদ হোসেনের চায়ের দোকান। ফরহাদ হোসেন বলেন, আমার চোখের সামনের ঘটনা। রূপমকে বাইরে থেকে ধরে নিয়ে আসে। হাত পেছন দিকে বাঁধা। রূপমকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে ব্যাপক মারধর করে। তার শব্দ আমরা শুনতে পাই। পরে সাড়ে ৯টা-পৌনে ১০টার দিকে দোতলা থেকে চারজন মিলে ধরে নিয়ে গাড়িতে করে নিয়ে যায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও বেশ কিছু বাহিনীর গাড়ি ছিল।
ফরহাদ হোসেন বলেন, ফজরের আজানের সময় দোকান খুলি। আমি দুধ–চা বিক্রি করি না। অন্য দোকান থেকে গুঁড়া দুধ কিনে অফিসারদের চা বানিয়ে খাইয়েছি। মুসল্লিরা চা খেতে দোকানে এলে যৌথ বাহিনীর লোকজন তাদের আসতে নিষেধ করেন। আমার দোকানে অন্য কাস্টমার কাল সকালে ঢোকেনি। কাল কোনো গ্যাঞ্জাম-ফ্যাসাদ কিছুই হয়নি।
রূপমদের প্রতিবেশী নাসির উদ্দীন বলেন, কাল এলাকায় কোনো মারামারি, গ্যাঞ্জাম, হাতাহাতি কিছুই হয়নি। যৌথ বাহিনীর ১০ থেকে ১২টা গাড়ি ছিল। গণপিটুনির যেসব কথা শোনা যাচ্ছে, এগুলো হয়নি।
রূপমের স্বজনরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রূপমকে ধরে দুইতলায় নেওয়ার পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তার ভাই-মা-বাবাকে আটকে রাখা হয় তখন। ব্যাপক মারধর করা হয় রূপমকে। একটা সময় রূপম নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। তার স্ত্রীকে তখন জিজ্ঞাসা করা হয়, রূপমের কোনো অসুখ আছে কি না। প্রেশার একটু লো ছাড়া কিছু নেই জানালে তারা স্যালাইন চায়। পানির বালতির মধ্যে রক্তবমি ছিল।
রূপমদের বাড়ির নিচতলার ভাড়াটিয়া নাজমা বেগম বলেন, রূপমের বাবা চাল-আটা বিক্রি করে। মনে করছিলাম এর কোনো তদন্তে বোধ হয় আসছে। তখন ৬ টা ১০ মিনিট বাজে। গেটে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলতে বলে। আমি বলেছিলাম, গেটের চাবি আমার কাছে নাই। রূপমের বোন ওপর থেকে এসে খুলে দেয়। আমার ঘরে ২০ থেকে ২৫ জন ঢুকে বলে, কোথাও যাওয়া যাবে না। আমার প্রসূতি মেয়েটা ঘরে ছিল। তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে রাখে। সাধারণ পোশাক পরা লোকজন ছিল। ঘরের ভেতর দুজন, আর সিঁড়ির মুখে ৫ থেকে ৭ জন বসেই ছিল। রূপমরে দুইতলায় নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে কী হয়েছে, তা বলতে পারব না। একটা সময় আমি বলেছি, রূপমকে কি নিয়ে যাবেন? তখন তারা বলে, না, কিছুই পাইনি, নেব না। রূপমকে যখন বের করে, ঠিক তখন কয়েকজন আমার ঘরে এসে তল্লাশি চালায়।
এ প্রসঙ্গে দৌলতপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, হাসপাতাল সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি যে তিনি (রূপম) গণপিটুনির শিকার হয়েছিলেন। ঘটনার একপর্যায়ে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেলে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, সুরতহালে আমরা দেখতে পেয়েছি, নিহত ব্যক্তির শরীরের বেশ কয়েকটি আঘাতের চিহ্ন ছিল। যতটুকু চিহ্ন দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে, একজন মানুষ মারা যাওয়ার মতো। তবে এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আরিফুজ্জামান রূপমের বিরুদ্ধে মাদকসহ চারটি মামলা রয়েছে। ২০২২ সালের ২৪ আগস্ট মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর দৌলতপুর থেকে ১৮টি ইয়াবা বড়িসহ তাকে গ্রেপ্তার করেছিল। এর আগে ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর দিঘলিয়া উপজেলার পানিগাতী গ্রাম থেকে আরিফুজ্জামানসহ দুজনকে ৩৯৫টি ইয়াবাসহ আটক করেছিল র্যাব।
তবে ওই এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে রূপম সম্পর্কে ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। কেউ বলেন রূপম একসময় দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকতেন। পরে দেশে ফিরে গরু, ছাগল-গাড়লের খামার নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আবার কেউ কেউ বলেন, রূপম নিজেই মাদক সেবন ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে ব্যাপকভাবে জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া খালার প্রভাবে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতেন। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিরও ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন