‘দেশের কোথাও মাদক পাওয়া না গেলেও খোদ রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে সবসময় মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়। ক্যাম্পের অন্তত ২০টি স্পটে বিক্রি হয় গাঁজা, হেরোইন ও ইয়াবা ট্যাবলেট। ক্যাম্পের কয়েকটি গ্রুপে নারী-শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের প্রায় দেড় হাজার মানুষ এসব মাদকদ্রব্য বিক্রির সঙ্গে জড়িত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে রয়েছে আলাদা কয়েকটি গ্রুপ। তবে মাদক কারবারের মূলে রয়েছে প্রতিটি সেক্টরের লিডাররা।’
কথাগুলো বলছিলেন সাহানুর নামে ক্যাম্পের এক মাদক কারবারি। রবিবার (৩ নভেম্বর) জেনেভা ক্যাম্পের ৪ নম্বর সেক্টরে মাদক বিক্রির সময় এ যুবকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ‘জেনেভা ক্যাম্পের জন্মলগ্ন থেকেই এখানে মাদকদ্রব্য বিক্রি হয়ে আসছে। এটা নতুন কিছু নয়।’
তাহলে হঠাৎ কেন জেনেভা ক্যাম্পে সংঘর্ষ, গোলাগুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। গত তিন মাসে সংঘাতে ৭ জন মারা গেছেন। এর নেপথ্যের কারণ কী, কারা এই ক্যাম্পকে উত্তপ্ত করে তুলছে? বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানে উঠেছে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। এছাড়া পরের পর্বে থাকছে ‘জেনেভা ক্যাম্পে তিন ধাপে ঢুকেছে শতাধিক আগ্নেয়াস্ত্র।’
মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসীদের ফাঁসির দাবিতে জেনেভা ক্যাম্পের প্রবেশ পথে ব্যানার
৩ মাস ধরে চলছে রক্তক্ষয়ী সংঘাত
জেনেভা ক্যাম্পে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গত তিন মাস ধরে রক্তক্ষয়ী সংঘাত চলছে। মূলত ক্যাম্পের মাদক কারবারি ও শীর্ষ সন্ত্রাসীরা দুটি গ্রুপে বিভক্ত। একটি আওয়ামী লীগ সমর্থিত বুনিয়া সোহেল গ্রুপ ও অন্যটি বিএনপি সমর্থিত চুয়া সেলিম গ্রুপ। গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর থেকে মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যকে কেন্দ্র করে অন্তত অর্ধশতবার সংঘর্ষে জড়িয়ে এ দুটি গ্রুপে সদস্যরা। এসব সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ ও বোমার আঘাতে সাত জনের মৃত্যুর পাশাপাশি শতাধিক মানুষ গুরুতর আহত হয়েছেন। এখনও বেশ কয়েকজন শরীরে আঘাতের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন।
জেনেভা ক্যাম্পের উত্তেজনা, সংঘর্ষ এবং সংঘর্ষের নেপথ্যে কারা? এ নিয়ে ক্যাম্পের একাধিক বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়—১৪ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা জেনেভা ক্যাম্পে ছোট ছোট খুপরি ঘরে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। ‘বায়ান্ন গলির তেপ্পান্ন রাস্তা’র এ ক্যাম্পে ৯টি ব্লক বা সেক্টর রয়েছে। ভেতরে প্রবেশ করলে মনে হবে শহরের মধ্যে এটি অন্য এক শহর। প্রতিটি সেক্টরে রয়েছে দুই থেকে তিনটি মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসী গ্রুপ। এসব গ্রুপ মূলত বিভিন্নভাবে মাদক কারবারে যুক্ত।
জানা যায়, ক্যাম্পে প্রতিদিন প্রায় অর্ধকোটি টাকার মাদক বিক্রি হয়। অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবীর নানক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নুর ইসলাম রাষ্টনসহ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রতি মাসে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দেওয়া হতো। ক্যাম্পের আরেক লিডার আওয়ামী লীগের নেতা মোল্লা বশিরের মাধ্যমে মাদকের টাকা ভাগবাটোয়ারা করা হতো। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বশিরের সঙ্গে মাদকের টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় মাদক কারবারের অন্যতম লিডার বুনিয়া সোহেলের। এরপর মোল্লা বশির বিএনপি সমর্থিত চুয়া সেলিমের সঙ্গে যোগ দিয়ে বুনিয়া সোহেলকে কোণঠাসা করার মিশন শুরু করেন। সেই থেকেই সংঘাতের সূত্রপাত।
জেনেভা ক্যাম্পের সংঘাতকে কেন্দ্র করে বুনিয়া সোহেলের গ্রুপে যোগ দেয় ৭, ৩ ও ৫ নম্বর সেক্টরের কয়েকটি গ্রুপ। এর মধ্যে কামাল বিরিয়ানি গ্রুপ, সৈদপুয়া গ্রুপ ও ভাইয়া সেলিম গ্রুপ অন্যতম। অপরদিকে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা বশির চুয়া সেলিমের সঙ্গে সঙ্গে যোগ। এছাড়া ক্যাম্পের ১, ২, ৪, ৬ ও ৮ নম্বর সেক্টরের গ্রুপগুলোও চুয়া সেলিমের গ্রুপে যুক্ত হয়ে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও বুনিয়া সোহেল গ্রুপকে বিতাড়িত করতে শক্তি প্রয়োগ করে যাচ্ছে। চুয়া সেলিমের সঙ্গে রয়েছে বোবা বিরিয়ানি গ্রুপ, লাড্ডু কসাই গ্রুপ, আনোয়ার গ্রুপ, চার্কু নুর ইসলাম গ্রুপ ও পিচ্চি রাজা গ্রুপ।
ক্যাম্পের প্রত্যেকটি গ্রুপেই একাধিক মাদক কারবারের গ্রুপ রয়েছে। মূলত ছোট ছোট গ্রুপের মাধ্যমে মাদক বিক্রি করা হয়। মাদক বিক্রির স্পটগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিভিন্ন কিশোর গ্যাংকেও ব্যবহার করা হয়। অপরদিকে প্রধান গ্রুপ ও গ্রুপের সদস্যরা প্রশাসন, ক্যাম্পের অন্যান্য সমস্যা এবং রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের কাজ করে থাকে। সম্প্রতি ক্যাম্পের সংঘর্ষে গ্রুপগুলোর লিডারদের কাছে ভারী অস্ত্র দেখা গেছে।
জেনেভা ক্যাম্পে মাদক কারবারি দুই গ্রুপের সংঘর্ষ
সেক্টরভিত্তিক গ্রুপে কারা রয়েছে?
৭ নম্বর সেক্টরে রয়েছে বুনিয়া সোহেলের তিন ভাই রানা, টুনটুন, রাজন কালো। বুনিয়া সোহেল গ্রেফতারের পর থেকে তারা নেতৃত্বে দিচ্ছে। এছাড়া এ গ্রুপের অন্যতম ক্যাডাররা হলো কলিম জাম্বু, মোটকি সীমার দুই ছেলে আরিফ ও ফরিদ, গোলাম জিলানী ও তার ছেলে নাসিম।
এই সেক্টরে বুনিয়া সোহেলের স্ত্রী শাহিনের নেতৃত্বে রয়েছেন সোহেলের ভাই রানার স্ত্রী শান্তা, বোন সুমি, মোটকি সীমা, শিমলাসহ কয়েকজন।
৬ নম্বর সেক্টরে লাড্ডু কসাইয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন তার ছেলে পারভেজ ও সোহেল কসাই, কাল্লু, পিচ্চি নারাসহ আরও কয়েকজন। এরা সবাই মাদক কারবারে জড়িত। এই গ্রুপটি ৫ আগস্টের পর চুয়া সেলিমের গ্রুপে যোগ দেয়।
৫ নম্বর সেক্টরে রয়েছে আনোয়ার হোসেন ওরফে কালো আনোয়ারের নেতৃত্বে লালন, গালকাটা মনু, পিচ্চি শাকিল, নিয়াজ ও কালো শাকিল। এরাও মাদক কারবারি গ্রুপের অন্যতম সদস্য। তারা বুনিয়া সোহেলের অধীনে ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
৩ নম্বর সেক্টরে রয়েছে সৈদপুরিয়া গ্রুপের ডানো, বোম, নওশাদ, রকি, হীরা, ভাগিনা মুক্তার ও সিয়ানা এবং নার্গিসের পরিবারের দুই মেয়ে, মেয়ের জামাই ও খালতো-মামতো ভাই-বোন। এরা সবাই ক্যাম্পের সৈদপুরিয়া গ্রুপের সদস্য। এছাড়াও মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী সুলতানের বউ নার্গিসের নেতৃত্বেও রয়েছে আরেকটি গ্রুপ।
৩ নম্বর সেক্টরে কামাল বিরিয়ানির নেতৃত্বে আরেকটি বড় গ্রুপ রয়েছে। এ গ্রুপে রয়েছে কামাল বিরিয়ানির ছেলে ইরফান, দিল্লি সাহিদ, গোলি জাহিদ, মিঠুন, জিন্দা মোহাম্মদ আলি, মুরগি সুমন, রনি, মাসুদ রানা ছোটু, ছোটুর ছেলে ইমতিয়াজ ও মোহাম্মদ দিন। ক্যাম্পের বড় কয়েকটি গ্রুপের মধ্যে এরা অন্যতম। কামাল গ্রুপটি মূলত বুনিয়া সোহেলের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া ভাইয়া সেলিম ও তার দুই ভাই আমিন ও আজমের একটি গ্রুপ রয়েছে। তারাও কামাল বিরিয়ানি গ্রুপের হয়ে মাদকের কারবার করে।
৪ নম্বর সেক্টরের গ্রুপটি চুয়া সেলিমের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এ গ্রুপের অন্যতম সদস্য হলো গাপ্পি দালাল, পার মনু, শাহ আলম, মনু, ফায়াজ ও শামিম।
সংঘর্ষ চলাকালে মাথায় হেলমেট ও অস্ত্র হাতে চুয়া সেলিম
২ নম্বর সেক্টরটি মূলত চুয়া সেলিমের গ্রুপের অধীন। পিচ্চি রাজা, উল্টা সালাম, বড় রাজা ও শাহজাদা এ গ্রুপের অন্যতম লিডার। এদের প্রত্যেকের রয়েছে আলাদা গ্রুপ। এরা মূলত চুয়া সেলিমের নেতৃত্ব সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে।
১ নম্বর সেক্টরের নেতৃত্বে রয়েছে বোবা বিরিয়ানি। বোবা বিরিয়ানি নামধারী আলতাফ ও তার ছেলে ইরফান, ফরমা কামরান, বিল্লা ইমরান, এরশাদ, আকরাম, আটে মন্নু সাজিদের ছেলে শামির ও মাছুয়া সাঈদ (পলাতক) সক্রিয় ক্যাডার। ৫ আগস্টের পর এই গ্রুপটি চুয়া সেলিমের হয়ে একাধিকবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে।
৮ নম্বর সেক্টরে চার্কু নুর ইসলাম, তার ছেলে ইরফান ও ইমরান এবং পিচ্চি শাকিলসহ কয়েকজন সক্রিয় সদস্য রয়েছে। এই গ্রুপটিও চুয়া সেলিমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
জেনেভা ক্যাম্প পরিচালনার জন্য এন.এল.আর.সি এবং এসপিজিআরসি নামে দুটি সংগঠন রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর এ দুটি কমিটির নেতারা সবাই পলাতক। এরপর গত ১২ সেপ্টেম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দারা কমিটি দুটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে এসপিজিআরসি’র একটি আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন।
ক্যাম্পে যেভাবে মাদক ঢুকছে
জেনেভা ক্যাম্পের চারপাশই মূলত উন্মুক্ত। যে কারণে বাধাহীনভাবেই এখানে মাদকদ্রব্য ঢুকছে। নারী ও বাচ্চাদের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য ঢোকানো হচ্ছে। এছাড়া ময়লার গাড়ি কিংবা বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রীর সঙ্গেও গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবাসহ যাবতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ে আসা হচ্ছে ক্যাম্পের ভেতরে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এখানকার এক মাদক কারবারি বলেন, দেশে যতদিন মাদক ঢুকবে, ততদিন ক্যাম্পেও মাদক আসবে। যখন প্রশাসনের অনেক কড়াকড়ি থাকে, তখন লুকিয়ে বিভিন্নভাবে আনা হয়। এখানে প্রতিদিন প্রায় অর্ধকোটি টাকার মাদক বিক্রি হয়।
নন-লোকাল জুনিয়র হাই স্কুলের শিক্ষক এসপিজিআরসি সংগঠনের আহ্বায়ক সৈকত আলী মাস্টার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ক্যাম্পের ভেতরে মাদকদ্রব্য যেকোনোভাবেই আসতে পারে। ক্যাম্পের বাইরে ও ভেতরে খোলামেলা মাদক বিক্রি হচ্ছে। আর নিয়ে আসাতো কোনও বিষয় নয়। তবে আমার কথা হলো—এত চেকপোস্টের মধ্যেও কীভাবে সীমান্ত পার হয়ে দেশে আসছে। এই জবাব সরকারকেই দিতে হবে। সরকার চাইলে দেশে আর মাদক আসবে না।’
ক্যাম্পের ভেতরে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ
এসপিজিআরসি সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমরা গত ২৭ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে ক্যাম্পের সার্বিক বিষয়ে একটা স্মারকলিপি দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার এপিএস সাব্বির হোসেন এটি রিসিভ করেছেন। এরপর থেকে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ক্যাম্পে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন।’ কী ছিল সেই চিঠিতে? এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের ক্যাম্পের ভেতরে কী কী অসুবিধা আছে, আমাদের কী কী চাহিদা, এই ক্যাম্পে আমরা কেন শান্তিতে থাকতে পারছি না—এসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া জেনেভা ক্যাম্পে কারা সংঘর্ষ করছে, কেন সংঘর্ষ হচ্ছে, কারা মাদক ব্যবসা করছে- আমাদের পক্ষ থেকে এসব বিষয় প্রধান উপদেষ্টাকে জানানো হয়েছে।’
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ রুহুল কবীর খান বলেন, জেনেভা ক্যাম্পে সংঘর্ষের ঘটনায় এ পর্যন্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারি বুনিয়া সোহেলসহ শতাধিক অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে ৮টি আগ্নেয়াস্ত্রসহ অর্ধশতাধিক দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। ক্যাম্পের আশপাশে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অভিযান চলমান রয়েছে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন