দরিদ্র পরিবারের সন্তান রানা পরিবারের হাল ধরার জন্য কাজের খোঁজে ঢাকায় গিয়েছিলেন। ঠিক তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। গত ২৫ জুলাই ঢাকার বসুন্ধরা এলাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের শটগানের গুলিতে হাত হারান তিনি। তার ডান হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। বাঁ হাতটিও ঝলসে গিয়ে পুরোটাই অকেজো। অর্থকষ্টে এখন তার চিকিৎসা বন্ধ হয়ে গেছে।
রানা নীলফামারী সদরে গোড়গ্রাম ইউনিয়নের তিলবাড়ী ময়দানপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবা দিনমজুর মিজানুর রহমান এবং মা সাবিনা ইয়াসমিন। গত জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুরুতর আহত হন রানা। ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারিতে প্রায় তিন মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর অর্থের অভাবে উন্নত চিকিৎসা করতে না পেরে গত ১৮ অক্টোবর বাড়িতে ফিরে আসেন।
রানা ছল ছল চোখে বলেন, ‘ওইদিন দুপুরে বসুন্ধরা এলাকায় স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের এক দফা দাবি আদায়ে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন সময় পুলিশের টিয়ার শেল, শটগানের গুলি চলতে থাকে আমাদের ওপর। পুলিশের গুলি থেকে বাঁচতে পালাতে চেষ্টা করি। হঠাৎ একটি বিকট শব্দে মাটিতে পড়ে যাই আমি। এরপর আর কিছুই বলতে পারি না। প্রায় পাঁচ-ছয় ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরে দেখি আমি হাসপাতালে। আমার ডান হাত কবজি থেকে নেই। আর বাঁ হাতটি ঝলসে গিয়ে অবশ।’
রানার মা সাবিনা ইয়াসমিন জানান, ঘটনার একদিন পর তারা রানার খবর পান। তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার পতন হলো, নতুন সরকার গঠন হলো, কিন্তু আমার ছেলের কেউ খবর নিলো না। ছেলের চিকিৎসার খরচ কোথায় পাবো, কে দেবে? আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। দুই মেয়ের পড়াশোনা ও ছেলের চিকিৎসার খরচ চালাতে পারছি না। ছেলেকে সুস্থ করতে সরকারের কাছে সাহায্য চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনার খবর পেয়ে ছেলের চিকিৎসার জন্য ওইদিন আমি বাড়ির একটি গরু ও একটি ছাগল বিক্রি করে টাকা পাঠিয়ে দিই। কিন্তু ওই সামান্য টাকায় তার কিছুই হয়নি। এখন কী করবো চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না।’
রানার বাবা মিজানুর রহমান আক্ষেপ করে বলেন, ‘আন্দোলনে গুলি খেয়ে আমার ছেলে পঙ্গু হলো। আজ নতুন বাংলাদেশের সুফল সবাই ভোগ করছে। গত তিন মাসেও সরকারের লোকজন খোঁজখবর নিতে এলো না। চিকিৎসা বাবদ একটি টাকাও কেউ দিলো না।’
তিনি বলেন, ‘ঘটনার পরের দিন হাসপাতাল থেকে জানায়, আপনার ছেলে ছাত্র আন্দোলনে গুরুতর আহত হয়ে ঢাকার বার্ন ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ভর্তি আছে। খবর পেয়ে, হাসপাতালে গিয়ে দেখি ছেলের ডান হাতের কবজি থেকে কাটা এবং বাঁ হাত ঝলসে গেছে। গোটা শরীর শটগানের ছররা গুলিতে ঝাঁঝরা।’
জানতে চাইলে রানা কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘আমার বাবা একজন দিনমজুর। অনেক কষ্ট করে আমাদের পাঁচ সদস্যের পরিবার চলে। তাই বাবাকে সহযোগিতার জন্য কাজের খোঁজে ঢাকায় আসি। সেখানে আন্দোলনে অংশ নিয়ে চিরদিনের জন্য হাত দুটি হারিয়ে ফেলি। আমার চিকিৎসার জন্য বাবার যতটুকু সহায় সম্বল ছিল, সবকিছু শেষ করেও সুস্থ হতে পারিনি। আমি এখন সমাজ ও পরিবারের বোঝা।’
তিনি বলেন, ‘নেতারা এখন রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। এখন কেউ আমাদের আর খবর রাখে না। খেয়ে না খেয়ে দিন যাচ্ছে, কেউ খবর নিতে এলো না।’
ওই ইউনিয়নের তিলবাড়ী ময়দানপাড়া গ্রামের রানার প্রতিবেশী মতিউর রহমান বলেন, ‘৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এসব তরুণদের ভূমিকা ভোলার নয়। অথচ আজ রানাকে পরিবারের বোঝা হয়ে সারাজীবন থাকতে হবে। তাই দেশবাসী এবং সরকারের কাছে তার চিকিৎসা ও ভাতার জন্য অনুরোধ জানাই।’
ওই ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘রানা আমার প্রতিবেশী। তার বাবা একজন দিনমজুর। বাবাকে সাহায্য করতে কাজের জন্য ঢাকায় যায় রানা। গত জুলাই মাসে ছাত্র জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে সে দুটি হাতই হারায়। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে না পেরে সে এখন পঙ্গু। আমি তার চিকিৎসার জন্য দেশের হৃদয়বান মানুষের কাছে সাহায্যের অনুরোধ জানাই।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন