চাঁদাবাজি ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে এবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার শরণাপন্ন হয়েছে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস সেক্টরের শীর্ষ স্থানীয় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান নোমান গ্রুপ।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবর এক আবেদনে চাঁদাবাজি ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের সঙ্গে হলুদ সাংবাদিক, নাম সর্বস্ব পত্রিকা, মানবাধিকার সংস্থার সমন্বয়ে একটি সংঘবদ্ধ চক্র এবং প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরিচ্যুত দুর্নীতিবাজ কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে।
চিঠির অনুলিপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে সিনিয়র সচিব, পুলিশের আইজি, সিআইডির অতিরিক্ত আইজিপি এবং ডিএমপি কমিশনারের কাছেও পাঠানো হয়েছে।
এই অভিযোগ ছাড়াও চাঁদাবাজি ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের এসব ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৮ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এদিকে, ১ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর দাখিল করা এই চিঠির একটি কপি বাংলা আউটলুকের হাতে এসেছে।
এ ব্যাপারে নোমান গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোহাম্মাদ আব্দুল্লাহ জাবেরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলা আউটলুককে বলেন, ‘ব্ল্যাকমেইলিং ও চাঁদাবাজি করাই এই সংঘবদ্ধ চক্রের মূল উদ্দেশ্য।’
‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে পরিশ্রম ও সততার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছি এবং লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির সাথে জড়িত নই। ফলে ঐতিহাসিক পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে টার্গেট করেছে চাঁদাবাজ চক্র। এই চক্রকে চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনা না হলে দেশের রপ্তানিখাত মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে,’ বলেন তিনি।
নোমান গ্রুপের একটি অফিসের ভেতরের দৃশ্য।
আব্দুল্লাহ জাবের আরও বলেন, ‘চক্রটি যে ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে তা শিল্প প্রতিষ্ঠানের ইমেজের ওপর ভয়াবহ আঘাত হানছে। বিশেষ করে নোমান গ্রুপের মতো রপ্তানিমুখি প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিটি নেতিবাচক খবরের জন্য বিদেশি ক্রেতাদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। আমরা সরকারি সংস্থা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আহ্বান জানাই, যেকোনো উড়ো চিঠি বা নামসর্বস্ব সংবাদমাধ্যমের খবরে প্রভাবিত না হয়ে, যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য।’
‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পরের পরিস্থিতে আমরা এমন একটি ব্যবসাবান্ধব বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, যেখানে সৎ ব্যবসায়ীরা হয়রানি ও চাঁদাবাজি থেকে মুক্ত থেকে স্বচ্ছন্দে ব্যবসা পরিচালনা করে দেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে পারবে,’ যোগ করেন তিনি।
তিনি জানান, বাংলাদেশের পোশাক ও বস্ত্র খাতে দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছরের পথ চলা নোমান গ্রুপের। রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে থেকে এই দীর্ঘ সময়ের যাত্রায় তারা বাংলাদেশের পোশাক খাতকে বিশ্ব দরবারে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। লাখো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করেছেন। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছেন নোমান গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা নুরুল ইসলাম।
নোমান গ্রুপ গত প্রায় ২৫ বছর ধরে ৯০৩টি আর্ন্তজাতিক ক্রেতার সঙ্গে সুনামের সঙ্গে রপ্তানি বাণিজ্য পরিচালনা করছে। ১.৩ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক টার্ন ওভারের এই গ্রুপে প্রায় ৮০ হাজার শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তা কাজ করছেন। জাতীয় অর্থনীতিতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফেব্রিক্স লিমিটেড বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে টানা ১২বার দেশের সেরা রপ্তানিকারক হিসেবে ‘জাতীয় রপ্তানি ট্রফি’ পেয়েছে।
এ ছাড়া কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বেকার সমস্যা সমাধান, মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান রাখায় জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফেব্রিক্স লিমিটেড ও নোমান টেরিটাওয়াল মিলস্ লিমিটেড একাধিকবার শিল্প মন্ত্রণালয়ের রাষ্ট্রপতি শিল্পোন্নয়ন পুরস্কার পায়। এই গ্রুপের চেয়ারম্যান ও পরিচালকবৃন্দ ২০০৭ সাল থেকে অদ্যবধি সিআইপি (রপ্তানি) ও সিআইপি(শিল্প) নির্বাচিত হয়ে আসছেন।
কিন্তু, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সংঘটবদ্ধ চাঁদাবাজ চক্র নোমান গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত তৈরি পোশাক কারখানায় চাঁদাবাজি শুরু করেছে। এমন অবস্থায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শরণাপন্ন হয়েছে নোমান গ্রুপ।
চাঁদাবাজি ও ব্ল্যাকমেইলিং থেকে পরিত্রাণ চেয়ে অভিযোগ
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবর চিঠিতে অভিযোগ করা হয়, নোমান গ্রুপ থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রতারণা, অনিয়ম ও চুরির দায়ে চাকরিচ্যুত কর্মকতা-কর্মচারী, কিছু নামসর্বস্ব পত্রিকার তথাকথিত সাংবাদিক, মানবাধিকার সংগঠন ও কতিপয় আইনজীবীর সমন্বয়ে গঠিত এই চক্রটি নোমান গ্রুপ ও এর চেয়ারম্যানের পারিবারিক, সামাজিক, ব্যবসায়িকভাবে ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের চেষ্টা করছে।
নোমান গ্রুপের একটি কারখানার ভেতরের দৃশ্য।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, কতিপয় স্বার্থান্বেষী সংঘবদ্ধ চক্রের এই দলটি অনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য পরস্পর যোগসাজশে নোমান গ্রুপ ও এর চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। এরা দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন পেশাজীবিসহ প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের টার্গেট করে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছে। এই চক্রটি নোমান গ্রুপ ও এর চেয়ারম্যানকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে যাচ্ছে। তাদেরই প্রত্যক্ষ ইন্ধনে ও মদদে এবং কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্ররোচনায় মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর, ভিত্তিহীন মিথ্যা দরখাস্ত সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দিয়ে এবং পত্রিকায় নিউজ ছাপিয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে।
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
হারুন অর রসিদ ওরফে বডি বিল্ডার্স হারুন ও আনোয়ার হোসেন তাদের তার দলবল পরস্পর যোগসাজশে হয়রানি ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের উদ্দেশ্যে নোমান গ্রুপের চেয়ারম্যানের অনুমতি ছাড়া তার ছবি ও নাম ব্যবহার করে ইচ্ছাকৃতভাবে সাবরিনা সুলতানা কেয়া নামক একটি ফেসবুক আইডি খুলে মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর, উসকানিমূলক, আক্রমণাত্মক ও মানহানিকর পোস্ট, ছবি প্রকাশ ও লিংক শেয়ার করছে। এই সংঘবদ্ধ চক্রটি অতীতে তাদের অবৈধ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নোমান গ্রুপ ও এর চেয়ারম্যানকে কখনো জামায়াত কখনো বিএনপির সঙ্গে সখ্য আছে মর্মে খবর ছড়িয়েছিল। আবার কখনো আওয়ামী লীগের ডোনার হিসেবে মিথ্যা প্রোপাগান্ড ছড়ায়। বাস্তবতা হচ্ছে নোমান গ্রুপ এবং এর চেয়ারম্যান বা পরিচালকবৃন্দ কেউ কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নন।
চিঠিতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের হয়রানি আর ব্ল্যাকমেইল করাই এই চক্রটির কাজ। নিজেদেরকে একটি মানবাধিকার সংগঠনের সদস্য হিসেবে সব জায়গায় পরিচয় দিয়ে এই চক্রের সদস্যরা হুমকি, ভয়ভীতি দিয়ে চাঁদা আদায় করছে।
এই চক্রের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে সুষ্ঠু ব্যবসায়িক পরিবেশে নোমান গ্রুপকে ব্যবসা করার সুযোগ দিতে সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়।
এদিকে, এসব ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কাজী মশিউর রহমান দীপু, কাজী আনোয়ার হোসেন, মো. হারুন অর রশিদ ওরফে বডি বিল্ডার হারুন, মো. হেলাল উদ্দিনসহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করা হয়।
অভিযোগের বিষয়ে সোমবার (২৮ অক্টোবর) হারুন অর রসিদের ব্যবহৃত ব্যক্তিগত চারটি মোবাইল নম্বরে কল করা হয়। তবে বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
অপর অভিযুক্ত আনোয়ার হোসেনকে সোমবার (২৮ অক্টোবর) বেলা ১২টার দিকে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা দেওয়া হলেও তিনি জবাব দেন নিন। এছাড়া তার ব্যবহৃত ব্যক্তিগত চারটি মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এছাড়া, অভিযুক্ত দেলোয়ার হোসেনের ব্যক্তিগত দুটি মোবাইল নম্বরও বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মামলার আসামি হেলাল উদ্দিন উদ্দিনের ফোন নম্বর এবং অপর আসামি কাজী মশিউর রহমানের ব্যক্তিগত ফোন নম্বরও বন্ধ রয়েছে।
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ ও নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। এমন পরিস্থিতি বেশ ঝুঁকিতে রয়েছে তৈরি পোশাক কারখানাগুলো। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান এ খাতকে নাশকতা থেকে রক্ষা করতে এরই মধ্যে সর্বোচ্চ নিরাপত্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে অন্তর্বতীকালীন সরকার।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন