সাভারের আশুলিয়ায় ভাবাইল উত্তরপাড়া গ্রামে গত ১২ সেপ্টেম্বর রহস্যজনক মৃত্যু হয় একই পরিবারের তিনজনের। তাঁরা হলেন—মিজানুর রহমান বাচ্চু (৫৩), তাঁর চতুর্থ স্ত্রী স্বপ্না বেগম (২৮) এবং তাদের মেয়ে জান্নাতুল (৪)। তাঁদের সঙ্গেই থাকতেন বাচ্চুর প্রথম ঘরের ছেলে তানভীর হাসান হিমেল (২২)।
ঘটনার দুই সপ্তাহ পর মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটন করে জানিয়েছে পিবিআই। হিমেল ও তাঁর সহযোগী তরিকুল ইসলাম তারেক ওরফে হৃদয় (২৮) ওই তিনজনকে খুন করেন এবং আত্মহত্যার নাটক সাজাতে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেন।
ঘটনার দিন রাতেই স্বপ্না বেগমের বোন লাবণ্য আক্তার বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
আজ মঙ্গলবার উত্তরার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ঢাকা জেলা কার্যালয়ে এসব তথ্য জানান পুলিশ সুপার মো. কুদরত-ই-খুদা।
ঢাকার নবাবগঞ্জ থেকে গত ৪ অক্টোবর তরিকুল ইসলাম তারেক ওরফে হৃদয়কে (২৮) গ্রেপ্তার করে পিবিআই। পরবর্তীতে তাঁকে আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ড আবেদন করলে চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হাতুড়ি, সিজার (কাঁচি) ও পুতুল জব্দ করা হয়। এরপর গত ২৪ অক্টোবর গোয়েন্দা তথ্য ও প্রযুক্তির সহযোগিতায় নিহত বাচ্চুর ছেলে তানভীর হাসান হিমেলকে আশুলিয়ার জিরাবো এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ সুপার কুদরত-ই-খুদা বলেন, ‘হত্যা মামলার আসামি তানভীর হাসান হিমেল ভিকটিম মিজানুর রহমান বাচ্চুর প্রথম স্ত্রীর সন্তান। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার পরে বাচ্চু আরও দুটি বিয়ে করলেও তাঁদের সঙ্গেও বাচ্চুর সংসার টিকেনি। স্বপ্না বেগম তাঁর চতুর্থ স্ত্রী। স্বপ্না বেগম ও বাচ্চুর সংসারে চার বছরের কন্যা জান্নাতুল রয়েছে। তাঁরা সবাই এক সঙ্গেই থাকতেন। বাচ্চু ও স্বপ্নার সঙ্গে হিমেলের পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। যার কারণে হিমেলকে হত্যার পরিকল্পনা করেন স্বপ্না বেগম ও বাচ্চু।’
তিনি বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের দেড় মাস আগে গ্রেপ্তারকৃত আসামি তরিকুল ইসলাম তারেক ওরফে হৃদয়কে (২৮) মিজানুর রহমান বাচ্চু তাঁর বাসায় নিয়ে আসেন। পরে তাঁর ফ্ল্যাটের সঙ্গে সংযুক্ত একটি রুমে থাকতে দেন এবং তাঁদের সঙ্গেই তাঁর খাবার দাবারের ব্যবস্থা করেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের ১০-১২ দিন আগে মিজানুর রহমান বাচ্চু, স্বপ্না বেগম এবং তরিকুল ইসলাম মিলে হিমেলকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তবে বিষয়টি গোপনে জেনে যান হিমেল।’
এসপি কুদরত বলেন, হিমেল পরবর্তীতে তরিকুল ইসলামের কাছে গিয়ে ঘটনার বিস্তারিত জানতে চান। একপর্যায়ে তরিকুল ইসলাম হত্যার পরিকল্পনার বিষয়টি হিমেলের কাছে স্বীকার করে। তখন হিমেল, তরিকুলের কাছে অনেক কান্নাকাটি করে তাঁকে ম্যানেজ করে। তখন হিমেল এবং তরিকুল মিলে বাচ্চু এবং স্বপ্না বেগমকে হত্যার পরিকল্পনা করে।’
গ্রেপ্তার তানভীর হাসান হিমেল ও তরিকুল ইসলাম তারেক ওরফে হৃদয়। ছবি: সংগৃহীত
তিনি বলেন, ‘ঘটনার দিন অর্থাৎ গত ১২ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টার দিকে স্বপ্না তার মেয়ে জান্নাতুলকে নিয়ে স্কুলে চলে যান। এ সময় মিজানুর রহমান বাচ্চু তাঁর ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। সকাল পৌনে ৯টার দিকে তরিকুল ও হিমেল মিলে বাচ্চুর শয়নকক্ষে প্রবেশ করেন। পরে হিমেল তার হাতে থাকা হাতুড়ি দিয়ে বাচ্চুর মাথায় পরপর দুটি আঘাত করেন এবং তরিকুল বাচ্চুর পা চেপে ধরে রাখে। সেই সঙ্গে তারেক বাচ্চুকে বালিশ চাপা দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। তারপর তাঁরা খাটের ওপর কাঁথা দিয়ে বাচ্চুর লাশ ডেকে রাখেন এবং স্বপ্নার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।’
পুলিশ কর্মকর্তা কুদরত বলেন, ‘অতঃপর সকাল অনুমান ১০টা ১০ মিনিটের দিকে স্বপ্না বেগম মেয়ে জান্নাতুলকে নিয়ে বাসায় এসে কলিং বেল চাপ দেন। তখন হিমেল ভেতর থেকে দরজা খুলে দিলে স্বপ্না বেগম শয়নকক্ষে প্রবেশ করে বাচ্চুকে ডাকতে থাকেন। তখন তরিকুল পেছন থেকে ভিকটিম স্বপ্না বেগমের গলা চেপে ধরে বিছানার ওপরে ফেলে বালিশ চাপা দিয়ে তাঁকেও হত্যা করেন। এ সময়ে জান্নাতুল চিৎকার করে উঠলে হিমেল তাকে মেঝেতে ফেলে মুখ চেপে ধরে এবং পাশেই থাকা খেলনা দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। পরবর্তীতে তরিকুল ও হিমেল লাশ তিনটিকে খাটের ওপরে পাশাপাশি শুইয়ে বিছানার চাদর দিয়ে ডেকে রাখে।’
তিনি বলেন, ‘হত্যার পর তাঁরা আলমারিতে থাকা স্বর্ণালংকার লুট করেন। এরপর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁরা রুমের ভেতরে কেরোসিন দিয়ে আগুন লাগিয়ে সিজার (কাঁচি) দিয়ে লোহার সিটের দরজা ছিদ্র করে বাইরে থেকে দরজার ভেতরের হ্যাজভোল্ট লাগিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পরে আগুনের ধোঁয়া চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে তারেক ও হিমেল আগুন আগুন বলে চিৎকার শুরু করে। তাদের চিৎকার শুনে এবং আগুনের ধোঁয়া দেখে বাসার অন্যান্য ভাড়াটিয়া ও স্থানীয় লোকজন এগিয়ে আসে। তারপর তাদের সহযোগিতায় আশপাশের লোকজন দরজা ভেঙে বাচ্চু, তার স্ত্রী স্বপ্না ও মেয়ে জান্নাতুলকে খাটের ওপরে শোয়ানো অবস্থায় দেখতে পায়।’
এসপি কুদরত বলেন, ‘হত্যার পরে আসামিরা হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া এবং হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে কেরোসিন তেল দিয়ে আগুন লাগিয়ে কৌশলে রুমের দরজার বাইরে থেকে লাগিয়ে দিয়েছিলেন।’
গ্রেপ্তার হওয়া দুজনকে আদালতে পাঠানো হলে তারা ১৬৪ ধারায় হত্যাকাণ্ডের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেন এবং বর্তমানে তাঁরা কারাগারে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন