কর্ণফুলী টানেল নিয়ে পরিচালিত জরিপে দৈনিক ২০ হাজার ৭১৯টি গাড়ি চলাচলের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু চালুর পর গত এক বছরে প্রতিদিন গড়ে গাড়ি চলাচল করে ৩ হাজার ৭০০-৮০০টি। যা লক্ষ্যমাত্রার ১৮-২০ শতাংশ। টানেলের উত্তর ও দক্ষিণ পাড়ে গড়ে ওঠেনি প্রত্যাশিত শিল্পকারখানা। ফলে শঙ্কায় পড়েছে ওয়ান সিটি টু টাউন নির্মাণের স্বপ্ন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর টানেল নিয়ে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। কেটে গেছে টানেল মোহ। তবে টানেলের আয় বাড়াতে কর্তৃপক্ষ এখন নয়া পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর ওপর দেশের প্রথম টানেলটি উদ্বোধন করা হয়।
টানেলে কৃত্রিম অক্সিজেন ও আলো সরবরাহ, সামগ্রিক নিরাপত্তা ও জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ আনুষঙ্গিক খাতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু গত এক বছরে দৈনিক টোল আদায় হচ্ছে গড়ে প্রায় ১১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। টানেলে বাইসাইকেল, অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল পারাপারের সুযোগ নেই।
জানা যায়, ওয়ান সিটি টু টাউনের আদলে ব্যবসাবাণিজ্য সম্প্রসারণ ও নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু ইতোমধ্যে কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। নদীর উত্তরপ্রান্তে পতেঙ্গা টার্মিনাল, বে-টার্মিনাল, দক্ষিণে চায়না ইকোনমিক জোন এবং মহেশখালীর মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ শিল্পাঞ্চলের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নেই। আনোয়ারা প্রান্তে কোরিয়ান ইপিজেড ছাড়া নতুন করে শিল্পকারখানা নির্মাণ বা ব্যবসায়িক সম্ভাবনাও তৈরি হয়নি। ফলে টানেলকে কেন্দ্র করে কালাবিবির দিঘির মোড় এলাকায় নতুন যাত্রা করা সাতটি ব্যাংকেও প্রত্যাশিত লেনদেন হচ্ছে না। টানেল ঘিরে চীনা শিল্পজোন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, আনোয়ারা প্রান্তে ছয়টি খাবারের দোকান খোলা হলেও দুটি বন্ধ। চালু থাকা দোকানগুলোও চলছে লাভ-লোকসান মিলিয়ে। ছোট-বড় মিলে ঝুপড়ি টাইপের অন্তত ৮০টি দোকান খোলা হয়। এখন দোকানগুলো মাসের ভাড়াও তুলতে পারছে না। চালুর পর প্রতিদিন দর্শনার্থীদের প্রচুর ভিড় হতো, এখন আর তা দেখা যায় না। কালাবিবির দিঘি এলাকায় গত এক বছরে সাতটি ব্যাংকের নতুন শাখা চালু করা হয়। প্রতিটি ব্যাংকে দৈনিক ১ কোটি টাকা লেনদেনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু এখন সাতটি মিলেই ২৫০ গ্রাহকের ১ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। এটি বড় একটি শাখার অর্ধেক লেনদেনের সমান। টানেল চালুর আগে-পরে প্রতি শতক জমির দাম ছিল মানভেদে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা। এখন প্রতি শতকে দাম কমেছে ১ থেকে ২ লাখ টাকা। বেঙ্গল ব্যাংক লি. কালাবিবির দিঘি শাখার ব্যবস্থাপক ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রত্যাশার ২০-৩০ শতাংশ পূরণ হচ্ছে। এখানে শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা না হলে ব্যাংক টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। অন্যান্য ব্যবসায়ীরাও শঙ্কায় আছেন।
নাম প্রকাশ না করে টানেলের একজন কর্মকর্তা বলেন, এখন দৈনিক ৩ হাজার ৭০০-৮০০টি গাড়ি চলাচল করছে। দৈনিক আয় হয় ১১ লাখ ৮০ হাজার টাকার মতো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, আমি আগেও বলেছি টানেল একটি দূরদর্শী প্রকল্প। তবে এর জন্য আরও ৫ থেকে ১০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। ততদিন পর্যন্ত এটি দেশের জন্য একটি সাদা হাতি প্রকল্প হবে। সরকারের পক্ষ থেকেই দৈনন্দিন ও প্রয়োজনীয় মেরামত করে যেতে হবে। তবে টানেলকে শতভাগ উপযোগী করতে হলে, মিরসরাই ইকোনমিক জোন থেকে ফৌজদার হাট-পতেঙ্গা রিং রোড-টানেল-আনোয়ারা-বাঁশখালী-মগনামা ঘাট-চকরিয়া-কক্সবাজার হয়ে মাতারবাড়ি পর্যন্ত সড়কটি নির্মাণ করতে হবে। একই সঙ্গে আনোয়ারা কোরিয়ান ইকোনমিক জোন এবং চায়না ইকোনমিক জোনকে পুরোপুরি কার্যকর করতে হবে। সড়ক বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, টানেলের অনতিদূরেই কর্ণফুলী সেতু। সেতুর তুলনায় টানেলের টোল বেশি। ফলে যানবাহনগুলো সেতুই ব্যবহার করছে। টানেল ব্যবহার করতে হলে নতুন করে ভাবতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টানেলের এমন লোকসানের মুখে গত শনিবার যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব সরেজমিন পরিদর্শনে আসেন। এর পর সার্কিট হাউসে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বৈঠক করে আয় বাড়াতে আগামী ছয় মাসের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়েছে। বৈঠকে কার-মাইক্রোর টোল কমানো, থ্রি হুইলার চালানো যায় কিনা তা চিন্তা করতে বলা হয়।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে কর্ণফুলী টানেল চালু হবে ধরে নিয়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় যান চলাচলের প্রাক্কলন করেছিল চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, ২০২০ সালে টানেল চালু হলে দিনে ২০ হাজার ৭১৯টি যানবাহন চলবে। প্রতি বছর তা ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বাড়বে। ২০২৫ সালে দৈনিক গড়ে ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলবে। ২০৩০ সালে সংখ্যাটি দাঁড়াবে দিনে প্রায় ৩৮ হাজার। তবে চালুর পর যানবাহন চলেছে গড়ে ৪ হাজার ৬১৩টি করে। টোল আদায় হচ্ছে দিনে গড়ে ১১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এর মধ্যে অধিকাংশই পর্যটকবাহী পরিবহন। চালুর শেষ ছয় মাস চলাচল করা যানবাহন আরও কমেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা থেকে আসা যানবাহনগুলো কক্সবাজার-টেকনাফ পর্যন্ত আনোয়ারা-বাঁশখালী-মগনামা ঘাট-চকরিয়া হয়ে কক্সাবাজার যেতে পারলে সহজে দ্রুত যাওয়া যেত। কিন্তু এখন ঢাকা থেকে আসা যানগুলো আবার শিকলবাহা ওয়াই জংশন হয়ে পটিয়া-চন্দনাইশ সড়ক দিয়ে কক্সবাজার যাচ্ছে। কার্যত টানেলের কার্যকারিতা এখানে বড় ধাক্কা খায়। কারণ টানেলে যে পরিমাণ টোল লাগে তার অর্ধেকে কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু হয়ে কক্সবাজার যাওয়া যাচ্ছে। ফলে টানেলের প্রতি মানুষের আগ্রহ দিন দিন কমছে। কেউ কেউ দেখার জন্য একবার পার হলেও দ্বিতীয়বার আর যাচ্ছে না। কেবল শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কিছু যাত্রী টানেল ব্যবহার করছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন