করোনা মহামারি অনেকটা বাধ্য করেছিল মানুষকে হাত ধোয়ার বন্দোবস্ত করতে। মহামারি থেকে বাঁচতে হাত ধোয়ার চর্চা বাড়লেও সেটি ধরে রাখা যায়নি। করোনা থেকে সুরক্ষার ব্যবস্থা হওয়ার পরও হাত ধোয়ার প্রতি আগের সেই উদাসীনতাই এখন সর্বত্র দেখা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, হাত ধোয়া চর্চায় বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। সংস্থাটির প্রকাশিত ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, ৩৮ শতাংশ পরিবারে এখনও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা নেই। এদিক দিয়ে ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা বেশ এগিয়ে আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাসাবাড়ি, হাসপাতালসহ নানা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্কুল ও অন্যান্য জনপরিসরে হাত ধোয়ার অভ্যাস জরুরি। আগামী মহামারি থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই হাত ধোয়ার প্রবণতা বাড়াতে হবে।
আজ ১৫ অক্টোবর বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস। সাধারণ মানুষকে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার মাধ্যমে রোগের বিস্তার রোধ করার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করার উদ্দেশ্যে প্রতি বছর ১৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। ‘বিশ্ব হাত ধোয়া দিবসে’ এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘পরিচ্ছন্ন হাত কেন এখনও গুরুত্বপূর্ণ।’
স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান নিয়ে ওয়াশের (ধোয়া) ওপর করা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের সর্বশেষ ‘যৌথ পর্যবেক্ষণ কর্মসূচি (জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রাম-জেএমপি) ২০২৩’-এর প্রতিবেদন চলতি মাসে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে ‘ফ্র্যাজাইল’ তালিকায় রাখা হয়েছে বাংলাদেশকে। এই তালিকায় থাকা অন্যান্য দেশ হচ্ছে—এঙ্গোলা, বেনিন, কম্বোডিয়া, ক্যামেরুন, গাম্বিয়া, উগান্ডা, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ইরান, কেনিয়া, লিবিয়া, সিয়েরা লিওন, তাজিকিস্তান, জাম্বিয়া, ইথিওপিয়া, জিম্বাবুয়ের মতো দেশ। ‘এক্সট্রিমলি ফ্র্যাজাইল’ গ্রুপের মধ্যে আছে বেশিরভাগ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, বাড়ির বাইরে বিশেষ করে দেশের হাসপাতালগুলোতে হাত ধোয়া ব্যবস্থার ঘাটতি আরও ব্যাপক। ৩৪ শতাংশ হাসপাতালে হাত জীবাণুমুক্ত রাখার মৌলিক ব্যবস্থা থাকলেও ৬৩ শতাংশ হাসপাতালে এই সুযোগ সীমিত। ৩ শতাংশ হাসপাতাল-ক্লিনিকে এর কোনও কিছুই নেই। জেএমপি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্য অপ্রতুল বলে জানিয়েছে তারা।
দিবসটি উপলক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক বাণীকে বলেছেন, ‘‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা। সে লক্ষ্যে ‘বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস’ যথাযথভাবে পালন ও হাইজিন প্রসারের সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’’
২০১৮ সালের জাতীয় হাইজিন সার্ভের তথ্য বলছে, ২৫ শতাংশ মানুষের হাত ধোয়ার অভ্যাস নেই। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের সর্বশেষ প্রকাশিত যৌথ পর্যবেক্ষণ কর্মসূচির (জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রাম-জেএমপি) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৬৩ শতাংশ হাসপাতালে হাত ধোয়া বা জীবাণুমুক্ত করার কোনও ব্যবস্থা নেই। সর্বজনীন হাত ধোয়ার চর্চা নিশ্চিত করতে একটি কৌশলপত্র তৈরি করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এতে বলা আছে, ২০৩০ সালের মধ্যে হাত ধোয়ার সর্বজনীন চর্চা নিশ্চিত করতে অবকাঠামোসহ নানা ধরনের সুবিধা দরকার। সেগুলো এখনও নিশ্চিত করা যায়নি।
ইউনিসেফের এক জরিপে দেখা গেছে, সারা বিশ্বে বছরে প্রায় ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন শিশু বা প্রতি চার জনে একজন শিশু ডায়রিয়া এবং নিউমোনিয়ায় মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস বছরে প্রায় ১০ লাখ ডায়রিয়াজনিত মৃত্যু এবং প্রায় ১৬ শতাংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের সংক্রমণজনিত রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে। তবে শুধু পানি দিয়ে হাত পরিষ্কার করলে তাতে জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে যায়। সেক্ষেত্রে ক্ষারযুক্ত সাবান, তরল সাবান বা অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার এসব ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু ধ্বংসের জন্য অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। বস্তুত, সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করার অভ্যাস যেকোনও মহামারি বা রোগের প্রাদুর্ভাব রোধ, কিংবা নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পানি-স্যানিটেশন এবং রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি একে অন্যের পরিপূরক। সেজন্য অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে হাসপাতালে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকা জরুরি।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালে হাত ধোয়ার সুবিধা না থাকায় সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে। একইসঙ্গে ভর্তি রোগীরা দেরিতে সুস্থ হচ্ছে। এজন্য হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স, রোগী, রোগীর আত্মীয়-স্বজন প্রত্যেকের জন্য হাত ধোয়ার যথেষ্ট পরিমাণ ব্যবস্থা থাকা দরকার। সেটা ওয়ার্ডের ভেতরে, করিডোরে, হাসপাতালের বাইরে থাকা উচিত।’
রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সচিব ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও ডা. কাকলী হালদার বলেন, ‘আমাদের হাত দিনের বেলায় অসংখ্য জিনিস স্পর্শ করে। যখন আমরা আমাদের মুখ, নাক বা চোখ স্পর্শ করি, তখন জীবাণুগুলো আমাদের শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন ধরনের রোগের কারণ হতে পারে। সর্দি, কাশি, ফ্লু থেকে শুরু করে আরও গুরুতর রোগ, যেমন- ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস, টাইফয়েড এমনকি কোভিড-১৯-এর মতো রোগও হতে পারে।’
ডা. কাকলী হালদারের মতে, চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিদিন অসংখ্য রোগীকে স্পর্শ করেন। তাদের হাতে থাকা জীবাণু একজন রোগী থেকে অন্য রোগীতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি হাসপাতালে সংক্রমণের একটি প্রধান কারণ। রোগীদের এমনিতেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে, তাই তাদের জন্য এই সংক্রমণ আরও বেশি ক্ষতিকর হতে পারে।
ডা. কাকলী আরও বলেন, ‘হাসপাতালে টয়লেটে পানি ও সাবানের ব্যবস্থা না থাকলে রোগী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। টয়লেট ব্যবহারের পর হাত না ধোয়ার কারণে বিভিন্ন ধরনের জীবাণু হাতে লেগে থাকতে পারে। এই জীবাণুগুলো পরে খাবার খাওয়া বা অন্য কোনও জিনিস স্পর্শ করার সময় শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন ধরনের রোগ সংক্রমণ করে, বিশেষ করে ডায়রিয়া, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং ‘ই’ জাতীয় রোগের প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি বেড়ে যায়।’
প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘হাত দিয়ে আমরা খাবার খাই। সেখানে হাতে লেগে থাকা ময়লা আমাদের মুখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। হাতে লেগে থাকা ময়লা চোখ, ত্বক ও নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। এ কারণে হাত ধোয়া আমাদের জন্য জরুরি। বিশেষ করে যে দেশের মানুষ মল ত্যাগের পরে শৌচ কাজে হাত ব্যবহার করে, সেখানে মলের সঙ্গে থাকা জীবাণু হাতে ও চোখে চলে আসতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেসব দেশে ধুলাদূষণ অত্যন্ত বেশি, সেখানে যেকোনও জায়গা থেকেই হাতে ময়লা চলে আসতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, হাত ধোয়ার কারণে নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা ৬০ ভাগ কমানো গিয়েছিল। তাই হাত ধোয়া অত্যন্ত জরুরি।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন