দেশের মূল্যস্ফীতি এখনো লাগামহীন। এর মধ্যে শ্রমিকরা তাদের শ্রম অনুযায়ী তাদের প্রাপ্য পান না। এখনো দেশের গড় মজুরির চেয়ে গড় মূল্যস্ফীতি বেশি। অর্থনীতির পরিভাষায়, কোনো দেশে গড় মজুরির চেয়ে গড় মূল্যস্ফীতি বেশি হলে সেটি অর্থনীতির সংকটকেই ইঙ্গিত করে। অবশ্য এমন পরিস্থিতির মধ্যেও কৃষিতে মজুরি বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ। আর এই মজুরি বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি কৃষিনির্ভর অঞ্চল রংপুরে। দেশের প্রবৃদ্ধিতে শিল্পের অবদান সবচেয়ে বেশি হলেও শিল্পনির্ভর চট্টগ্রামের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির হার সর্বনিম্ন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হালনাগাদ ভোক্তা মূল্যসূচকের (সিপিআই) সেপ্টেম্বরের তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে গড় মজুরি বৃদ্ধির হার ৮ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ, একই সময়ে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। অর্থাৎ গড় মজুরির চেয়ে গড় মূল্যস্ফীতির ব্যবধান ১ দশমিক ৯১ শতাংশীয় পয়েন্ট।
সারা দেশের ৮ বিভাগের মজুরির তথ্য দিয়ে থাকে বিবিএস। সেপ্টেম্বরে সব বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ মাসে মজুরি বৃদ্ধির হারে শীর্ষে ছিল কৃষিনির্ভর রংপুর অঞ্চল। সেপ্টেম্বরে এ বিভাগের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ, যা বিভাগগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে শিল্পনির্ভর ও অর্থে স্বয়ংসম্পূর্ণ চট্টগ্রাম বিভাগের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির হার সর্বনিম্ন, ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। অর্থাৎ দুই বিভাগের মধ্যে মজুরির ব্যবধান ১ দশমিক শূন্য ৩।
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারি হিসাব বলছে, দুই বছরের বেশি সময় দেশের গড় মজুরির চেয়ে গড় মূল্যস্ফীতি বেশি। অথচ উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা যে খাদ্যপণ্য, সেটি উৎপাদনে জড়িত কৃষকরা পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। যদিও শিল্প ও সেবা খাতের অন্যান্য পেশার তুলনায় কৃষকদের মজুরি বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি। তারপরও দেশের কৃষকরা কৃষি ছেড়ে অন্য পেশা খোঁজায় মন দিয়েছেন। এতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বলে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিবিএস শ্রম শক্তি জরিপের জুন শেষের তথ্য বলছে, এক বছরের ব্যবধানে দেশের ২ লাখ ৩০ হাজার কৃষক তাদের পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যোগ দিয়েছেন। ২০২৪ সালের জুন শেষে কৃষিতে জড়িত শ্রমিকের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৯ লাখ ২০ হাজারে। আগের বছরের একই সময়ে দেশে কৃষক ছিলেন ৩ কোটি ১১ লাখ ১৫ হাজার।
এ সময়ে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক হারিয়েছে সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। এক বছরের ব্যবধানে ১০ লাখ ৪০ হাজার শ্রমিক তাদের পেশা হারিয়েছে। তবে শিল্পখাতের শ্রমিকের সংখ্যা এ সময়ে বেড়েছে। এ সময়ে শিল্পখাতে ২ লাখ শ্রমিক বেড়েছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নাজুক পরিস্থিতি চলছে। এটি গত দুই বছরের ধারাবাহিক চিত্র। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক দেরিতে হলেও গত অর্থবছর থেকে সুদের হার বাড়িয়ে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে আসছে। ফলে ব্যাংকের তারল্য কিছুটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এর প্রভাব পড়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মধ্যে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, কৃষি ও সেবা খাতের বিভিন্ন পর্যায়ে বিনিয়োগ কমে যায়। কাজ হারাতে থাকেন অনেক শ্রমিক।
একই সময়ে দেশের শিল্প খাতও ধুঁকছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন না হওয়ায় ব্যাঘাত ঘটেছে শিল্প খাতের উৎপাদনে। যদিও জুন শেষে দেশের সেবা ও কৃষি খাতে শ্রমিক কমলেও শিল্প খাতে বেড়েছে বলে উঠে এসেছে চিত্রে। সারা দেশের গড় মজুরির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের কৃষি খাতের মজুরি সবচেয়ে বেশি ছিল, তবে এখন তা দ্বিতীয় অবস্থানে। সেবা খাতের মজুরি দেশের সব খাতের চেয়ে শীর্ষে। রপ্তানিতে অবদান রাখা শিল্প খাতের মজুরি সবচেয়ে কম।
কৃষি খাতের মজুরি ৮ দশমিক ২৮ শতাংশ বেড়েছে সেপ্টেম্বরে। তবে কৃষি পেশায় জড়িতদের মধ্যে মৎসজীবীদের মজুরি বৃদ্ধির হার সবচেয়ে কম। কৃষি ক্ষেত্রে চাষিদের মজুরি ৮ দশমিক ৩৫ ও মৎসজীবীদের মজুরি বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ।
দেশে কৃষির সম্ভাবনা অনেক। উৎপাদনও বাড়ছে। বলা হয়, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উৎপাদন করছেন, তারাই বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন। সরকারি তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে কৃষির ওপর নির্ভরশীল ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অথচ অন্য পেশায় থাকা মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা আরও কম, গড়ে ২০ শতাংশ। এ কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হিসেবেও সামনে আসছে কৃষি। কৃষির ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোর এ হতাশার প্রভাব পড়তে পারে পুরো কৃষি খাতে। ফলে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় পড়তে পারে।
কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের কৃষকরা উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য উৎপাদন করলেও নিজের জন্য কিছুই রাখেন না। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে উৎপাদিত ফসল মাঠেই বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে, কৃষক যে খাদ্য ফলান, একটি পর্যায়ে গিয়ে সে খাদ্যই বেশি দামে কিনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে তাদের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা সবচেয়ে বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক।
শিল্প খাতের গড় মজুরি বৃদ্ধির হার সব খাতের মধ্যে সর্বনিম্ন। শিল্প খাতে অবকাঠামোর চেয়ে উৎপাদনে মজুরি বৃদ্ধির হার বেশি। শিল্প খাতের গড় মজুরি ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ, যেখানে অবকাঠামোর শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫৫ ও উৎপাদনের মজুরি বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৯৮।
ঘুষে দর-কষাকষি একদম ভালো লাগত না রুহুল হকেরঘুষে দর-কষাকষি একদম ভালো লাগত না রুহুল হকের
বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২-এর তথ্য মতে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের প্রায় ৩৭ শতাংশ মানুষ ঋণ করে সংসার চালাচ্ছে। বর্তমানে জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের গড় ঋণ ৭৩ হাজার ৯৮০ টাকা। আর ঋণগ্রস্ত পরিবারের গড় ঋণ এক লাখ ৮৭ হাজার ৩০৮ টাকা। গ্রামের তুলনায় শহরের পরিবারগুলোর ঋণ প্রায় ২১০ শতাংশ বেশি। শহরের ঋণগ্রস্ত পরিবারের গড় ঋণ চার লাখ ১২ হাজার ৬৩৮ টাকা। ঢাকা বিভাগের পরিবারগুলোর ঋণ সবচেয়ে বেশি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন