সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মালিকানাধীন সিটিজেনস ব্যাংক পিএলসির ব্রাহ্মণবাড়িয়া কসবায় একটি শাখা চালু হয় ২০২২ সালের ১২ নভেম্বর। এর পর থেকে আনিসুল হকের সংসদীয় আসন কসবা ও আখাউড়া উপজেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বড় ব্যবসায়ীদের ওপর নেমে আসে অ্যাকাউন্ট খোলা কিংবা এফডিআর, ডিপিএস করার ‘খড়্গ’।
অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে চাপ দিয়ে অন্য ব্যাংক থেকে প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির টাকা সিটিজেনস ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে নিয়ে যাওয়া হতো। আখাউড়ার বাসিন্দা ওই ব্যাংকের এক কর্মকর্তা এ কাজে সহায়তা করতেন।
কার কার বেশি টাকা আছে এসব তথ্য ওই কর্মকর্তা দেওয়ার পর রাজনীতিবিদরা তাঁদের চাপ দিতেন।
আখাউড়ায় এক ডজনের মতো সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থাকলেও পৌরসভার টাকার একটি বড় অংশ রাখা হয় কসবার সিটিজেনস ব্যাংকের শাখায়। কেননা, ওই সময় পৌর মেয়র ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাকজিল খলিফা কাজল। আখাউড়ায় তাকজিল খলিফাই মূলত প্রভাব খাটিয়ে সিটিজেনস ব্যাংকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের টাকা রাখতে বাধ্য করাতেন।
কসবায় ব্যাংকের আর্থিক অবস্থান দৃঢ় করতে কাজ করতেন সাবেক আইনমন্ত্রীর আরেক ঘনিষ্ঠজন ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রাশেদুল কায়সার ভূঁইয়া জীবন। তবে ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর থেকে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। চাপ দিয়ে যাঁদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছিল তাঁদের অনেকেই টাকা ওঠাতে শুরু করেন। অনেকে আবার ব্যাংক কী অবস্থায় যায়, সেই ভয় থেকেও টাকা উঠিয়ে ফেলেন।
২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে সিটিজেনস ব্যাংক পিএলসি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পায় এবং এটাকে তফসিলি ব্যাংক হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। ব্যাংকটির মালিকানায় ছিলেন আনিসুল হকের মা বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহানারা হক। তিনি মারা যাওয়ার পর মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন তৌফিকা আফতাবকে ব্যাংকের চেয়ারম্যান বানানো হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা জানান, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের টাকা তাঁদের ব্যাংকে এফডিআর করা ছিল। মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন তাকজিল খলিফা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষকে চাপ দিয়ে ওই টাকা সিটিজেনস ব্যাংকে নিয়ে যান।
আখাউড়া পৌরসভার একটি সূত্র জানায়, তৎকালীন মেয়র একক সিদ্ধান্তে প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের টাকা সিটিজেনস ব্যাংকে রাখেন। তবে শিগগিরই ওই টাকা সেখান থেকে আনার প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।
সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বর্তমানে একাধিক মামলায় জেলহাজতে আছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠজন সিটিজেনস ব্যাংকের চেয়ারম্যান তৌফিকা আফতাবও দেশে ছেড়ে কানাডায় চলে গেছেন বলে শোনা যায়। তৌফিকা দেশ থেকে হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ আছে।
এ বিষয়ে সিটিজেনস ব্যাংক নয়নপুর শাখার ব্যবস্থাপক সেলিম রেজা বলেন, ‘শাখাটি উদ্বোধনের এক মাস পর এখানে যোগ দিই। আমি যোগদানের পর কারো কাছ থেকে জোর করে টাকা আনার কোনো ঘটনা ঘটেনি। আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে আমাদের ডিপোজিট বেড়েছে। অন্য অনেক ব্যাংক যেখানে চাহিদামতো গ্রাহকের টাকা দিতে পারছে না, সেখানে আমরা শতভাগ পারছি।’
ব্যাংকের মালিকানার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের বোর্ড অব ডিরেক্টরে ১৪ জন আছেন। সাবেক আইনমন্ত্রী শুধু ব্যাংকের একজন শেয়ারহোল্ডার।’
জনসেবা ও উন্নয়নের নামে ফাঁকা বুলি
আনিসুল হক ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর কথা ও কাজের মিল রেখে তাঁর নির্বাচনী এলাকা কসবা ও আখাউড়া উপজেলার মানুষের মন জয় করে নেন। গণসংবর্ধনায় উপস্থিতদের মধ্যে পাঁচ হাজার গাছের চারা বিতরণ করেও প্রশংসা কুড়ান তিনি। সাধারণ মানুষের ফোনও ধরতেন।
তবে দিন যত যায় পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে থাকে। চাটুকারবেষ্টিত থাকা সাবেক এই মন্ত্রী কথা ও কাজের মিল রাখতে পারতেন না। তিনি নিজে কিছু বললেও চাটুকারদের স্বার্থ উদ্ধার না হলে তাঁরা ওই কাজটি করতে দিতেন না। সাধারণের ফোন ধরাও বন্ধ হয়ে যায়।
চাকরি দেওয়ার বিনিময়ে টাকা না নেওয়ার কথা বলতেন মন্ত্রী। কিন্তু তিনি সরাসরি টাকা না নিলেও তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা চাকরি দেওয়ার নাম করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।
এলাকাবাসীর মন্তব্য, কয়েক বছর ধরে মন্ত্রী খুব ফাঁকা বুলি আওড়াতেন। আখাউড়ায় একাধিক সভা-সমাবেশে একটি মিনি স্টেডিয়াম করার ঘোষণা দিয়েও তিনি পাঁচ-সাত বছরে তা বাস্তবায়ন করেননি। আখাউড়ার আজমপুর রেলস্টেশনে দুটি আন্ত নগর ট্রেন যাত্রাবিরতির ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা করেননি।
কসবা ও আখাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগকে মডেল হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিলেও সেটা তিনি করতে পারেননি। নিজেই বনে যান কসবা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ঘনিষ্ঠজন ও এপিএস অ্যাডভোকেট রাশেদুল কায়সার জীবনকে বানান সাধারণ সম্পাদক। আখাউড়ায় প্রবীণ সব রাজনীতিবিদকে ‘মাইনাস’ করে তিনি সাধারণ সম্পাদক করেন আরেক ঘনিষ্ঠজন পৌর মেয়র তাকজিল খলিফা কাজলকে, আর তাকজিল খলিফার পছন্দের লোক মোহাম্মদ আলী ভূঁইয়াকে সভাপতি করেন।
যে কারণে আখাউড়া আওয়ামী লীগের পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে আসে তাকজিলের হাতে। তাকজিল খলিফা একই সঙ্গে উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়কের পদও বাগিয়ে নেন। কয়েক মাসের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কয়েক বছরেও আখাউড়া আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেননি আনিসুল হক।
আনিসুল হক গ্রেপ্তারের খবরে কসবা ও আখাউড়ায় একাধিক আনন্দ মিছিল, সভা বের করে বিএনপি। এসব কর্মসূচি থেকে অভিযোগ করা হয়, আনিসুল হক মুখে রাজনৈতিক সহাবস্থানের কথা বললেও কসবা ও আখাউড়ায় বিএনপিকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে দেওয়া হয়নি। তিনি অনেককে মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন। এলাকার রাস্তাঘাট দেখলেই বোঝা যায় তিনি উন্নয়নের নামে ফাঁকা বুলি আওড়ে গেছেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন