নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান ডা. আ ফ ম রুহুল হক। ডা. রুহুল হক যখন দায়িত্ব নেন, তখন দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ছিল ৪০। তিনি যখন মেয়াদ পূর্ণ করেন, তখন তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫। অর্থাৎ এক মেয়াদেই তিনি ২৫ মেডিকেলের অনুমোদন দেন। শুধু তাই নয়, একই সময়ে বেসরকারি সাতটি ডেন্টাল কলেজও অনুমোদন দেওয়া হয়। বর্তমানে দেশে ৬৭টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ১২টি বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ রয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি ডেন্টাল ইউনিট আছে ১৬টি।
দেশের ইতিহাসে ডা. রুহুল হকের আগে বা পরে কোনো মন্ত্রী এতগুলো মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেননি। প্রয়োজন আছে কি না কিংবা যেসব কলেজের জন্য আবেদন করা হচ্ছে, সেগুলো যোগ্যতার শর্ত পূরণ করছে কি না এসবের কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করা হয়নি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে রুহুল হকের আমলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা একাধিক উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, ওই সময় এক একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অনুমোদনের জন্য দুই কোটি টাকা করে ঘুষ নিয়েছেন মন্ত্রী। এ ছাড়া কলেজের আসন বাড়াতে তাকে দিতে হতো আসনপ্রতি ২০ লাখ টাকা।
রুহুল হকের সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, মেডিকেল কলেজ অনুমোদনে ঘুষ নিয়ে কোনো দেনদরবার তিনি পছন্দ করতেন না। রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক চাপ ও তদবির থাকলেও টাকা ছাড়া কোনো মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দিতে নারাজ ছিলেন রুহুল হক।
উদ্যোক্তারা কেন টাকা দিয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন নিতেন এমন প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তারা বলেন, মেডিকেল শিক্ষা ও জাতির উন্নয়নের কথা চিন্তা করে কলেজ করেন না বেশিরভাগ মালিকই। তারা বাণিজ্যিক কারণেই কলেজ খোলেন। এটা সেবা নয়, ব্যবসা খাতে পরিণত হয়েছে। ফলে অনুমোদনের বিপরীতে ঘুষ দেওয়াকে উদ্যোক্তারা ব্যবসায়িক বিনিয়োগ মনে করেন।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সাবেক এক কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজের মালিক ছিলেন স্বাচিপের প্রভাবশালী নেতা ডা. আবু সাঈদ। মেডিকেল কলেজের অনুমোদন পেতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. রুহুল হকের কাছে গেলে তার কাছে টাকা দাবি করা হয়। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের কাছে নালিশও করা হয়।
মেডিকেল কলেজের নীতিমালায় বলা আছে, ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করতে মহানগর (মেট্রোপলিটন) এলাকায় কলেজের নামে দুই একর জমি অথবা নিজস্ব ভবনে এক লাখ বর্গফুট ফ্লোর স্পেসের অ্যাকাডেমিক ভবন ও এক লাখ বর্গফুটের ফ্লোর স্পেসের হাসপাতাল ভবন থাকতে হবে। মহানগর এলাকার বাইরে চার একর নিজস্ব জমি অথবা উল্লিখিত ফ্লোর স্পেস থাকতে হবে। কোনো ভাড়া বাড়িতে কলেজ করা যাবে না। এ ছাড়া ৫০ শিক্ষার্থীর জন্য হাসপাতালে কমপক্ষে ২৫০ শয্যার অবকাঠামো থাকবে এবং নিয়মিত ৭০ শতাংশ শয্যায় রোগী ভর্তি থাকবে।
২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বেসরকারি যেসব মেডিকেলের কলেজ অনুমোদন দেওয়া হয়, তার বেশিরভাগই প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করেনি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজির আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীদের নিয়ে বাণিজ্যের একটি ফাঁদ। বাণিজ্যিক কারণে কলেজগুলোর অনুমোদন দেওয়ার কারণেই এসব কলেজে শিক্ষার মান তলানিতে। অনুমোদন দেওয়া নিয়েও শুরু থেকেই নানা অভিযোগ ছিল।’
রুহুল হকের সময়কার ওই কর্মকর্তারা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের একেবারে শেষ সময়ে ২০১৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ১২টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়। শিক্ষকসংখ্যা, শিক্ষার মান, আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা সন্তোষজনক নয় বলে রিপোর্ট দেওয়া হলেও, অদৃশ্য ইশারায় অনুমোদন পেয়ে যায় কলেজগুলো। এ কারণে পরবর্তী স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম দায়িত্ব নিয়েই এসব কলেজের অনুমোদন স্থগিত করেন। এই কলেজগুলো হচ্ছে ঢাকায় কেয়ার মেডিকেল কলেজ, ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ, ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ; নারায়ণগঞ্জে ইউএস-বাংলা মেডিকেল কলেজ; চট্টগ্রামে মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজ, সিলেটে পার্ক ভিউ মেডিকেল কলেজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), কিশোরগঞ্জে আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজ, খুলনায় আদ-দ্বিন মেডিকেল কলেজ ও খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ, রংপুরে কছিরুদ্দিন মেডিকেল কলেজ এবং রাজশাহীতে শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজ। পরে পর্যায়ক্রমে বেশিরভাগ কলেজকে অনুমোদন দেওয়া হয়।
এ ছাড়া আদালতের রায়ে রাজশাহীর শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমতি পায়। যদিও এখন কলেজটি সমস্যা ও সংকটের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পায়নি। প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত ৯টি ব্যাচে শিক্ষার্থী ভর্তি করেছে শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ না করায় তারা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) নিবন্ধিত হতে পারেনি। রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠানটিকে অধিভুক্ত করেনি। কলেজটির প্রথম থেকে সপ্তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা মাইগ্রেশন নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে গিয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন। ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা মাইগ্রেশন না পেয়ে আদালতে ২১টি পৃথক মামলা করেছেন। খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজের ক্লাস নেওয়া হয় ভাড়া করা একটি আবাসিক ভবনে। যদিও এ ধরনের ভবনে মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম চলার কথা নয়। শিক্ষার্থীদের জন্য নেই কোনো সুযোগ-সুবিধা।
ছয়টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজকে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমতি দেয়নি স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। যার মধ্যে রুহুল হকের আমলে অনুমোদন পাওয়া শাহ মখদুম ও কেয়ার মেডিকেল কলেজ রয়েছে।
একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নানা কাজ ও তদবিরের জন্য ডা. রুহুল হকের হয়ে টাকা নেওয়া শুরু করেন তার স্ত্রী ইলা হক ও ছেলে জিয়াউল হক।
অভিযোগের বিষয়ে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. রুহুল হক, তার স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রুহুল হক, তার স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ের ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। একই সঙ্গে তাদের মালিকানাধীন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে লেনদেন স্থগিত রাখতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে সংস্থাটি।
বিএফআইইউর চিঠিতে বলা হয়েছে, উল্লিখিত চারজন ও তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো হিসাব পরিচালিত হয়ে থাকলে সেই হিসাবের লেনদেন ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় ৩০ দিনের জন্য স্থগিত রাখা এবং তাদের নামে কোনো লকার থাকলে তার ব্যবহার ৩০ দিনের জন্য বন্ধ করার নির্দেশনা দেওয়া হলো।
ব্যাংক হিসাব স্থগিতের চিঠিতে আ ফ ম রুহুল হক, তার স্ত্রী ইলা হক, ছেলে জিয়াউল, মেয়ে মেহজাবিন হকের জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ও জন্মতারিখ উল্লেখ করা হয়েছে।
নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জমা দেওয়া হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রুহুল হকের সম্পদের পরিমাণ বেড়েছিল ১১০ শতাংশ এবং তার স্ত্রী ইলা হকের ৭৮২ শতাংশ। এ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে। নবম সংসদের আগে রুহুল হকের ব্যাংক হিসাবে ছিল ৮৮ লাখ টাকা। দশম সংসদের আগে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় তার ব্যাংক হিসাবে রাখা টাকার পরিমাণ দেখানো হয় ২ কোটি ৬৩ লাখ। একইভাবে ইলা হকের ব্যাংক হিসাবে রাখা টাকার পরিমাণ ৪ লাখ ৬৪ হাজার থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৭ কোটি ৫৩ লাখ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন