নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান ডা. আ ফ ম রুহুল হক। শপথ নিয়েই বলেছিলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিন্ডিকেট ভাঙতে চান তিনি। তবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি তা বেমালুম ভুলে গিয়ে নিজেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। আওয়ামীপন্থি স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) তখনকার সভাপতি মন্ত্রী হয়ে সিন্ডিকেট ভাঙার বদলে নিজেই ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট।
একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তার স্ত্রী ইলা হক, ছেলে জিয়াউল হক, ভগ্নিপতি নাজমুল আরেফিন মিন্টু, এপিএস মোশায়েদ আলী খোকন রুহুল হকের হয়ে নানা দেন দরবার করে টাকা নেওয়া শুরু করেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে রুহুল হকের আমলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা একাধিক উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, ওই সময় এক একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অনুমোদনের জন্য দুই কোটি টাকা করে ঘুষ নিয়েছেন মন্ত্রী। এ ছাড়া কলেজের আসন বাড়াতে তাকে দিতে হতো আসনপ্রতি ২০ লাখ টাকা।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে ডা. রুহুল হক যখন দায়িত্ব নেন, তখন দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ছিল ৪০। তিনি যখন মেয়াদ পূর্ণ করেন, তখন তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫। অর্থাৎ এক মেয়াদেই তিনি ২৫ মেডিকেলের অনুমোদন দেন। শুধু তাই নয়, একই সময়ে বেসরকারি সাতটি ডেন্টাল কলেজও অনুমোদন দেওয়া হয়। বর্তমানে দেশে ৬৭টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ১২টি বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ রয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি ডেন্টাল ইউনিট আছে ১৬টি। দেশের ইতিহাসে ডা. রুহুল হকের আগে বা পরে কোনো মন্ত্রী এতগুলো মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেননি। প্রয়োজন আছে কি না কিংবা যেসব কলেজের জন্য আবেদন করা হচ্ছে, সেগুলো যোগ্যতার শর্ত পূরণ করছে কি না এসবের কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করা হয়নি।
রুহুল হকের সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, মেডিকেল কলেজ অনুমোদনে ঘুষ নিয়ে কোনো দেনদরবার তিনি পছন্দ করতেন না। রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক চাপ ও তদবির থাকলেও টাকা ছাড়া কোনো মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দিতে নারাজ ছিলেন রুহুল হক।
উদ্যোক্তারা কেন টাকা দিয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন নিতেন এমন প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তারা বলেন, মেডিকেল শিক্ষা ও জাতির উন্নয়নের কথা চিন্তা করে কলেজ করেন না বেশিরভাগ মালিকই। তারা বাণিজ্যিক কারণেই কলেজ খোলেন। এটা সেবা নয়, ব্যবসা খাতে পরিণত হয়েছে। ফলে অনুমোদনের বিপরীতে ঘুষ দেওয়াকে উদ্যোক্তারা ব্যবসায়িক বিনিয়োগ মনে করেন।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সাবেক এক কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজের মালিক ছিলেন স্বাচিপের প্রভাবশালী নেতা ডা. আবু সাঈদ। মেডিকেল কলেজের অনুমোদন পেতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. রুহুল হকের কাছে গেলে তার কাছে টাকা দাবি করা হয়। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের কাছে নালিশও করা হয়।
মেডিকেল কলেজের নীতিমালায় বলা আছে, ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করতে মহানগর (মেট্রোপলিটন) এলাকায় কলেজের নামে দুই একর জমি অথবা নিজস্ব ভবনে এক লাখ বর্গফুট ফ্লোর স্পেসের অ্যাকাডেমিক ভবন ও এক লাখ বর্গফুটের ফ্লোর স্পেসের হাসপাতাল ভবন থাকতে হবে। মহানগর এলাকার বাইরে চার একর নিজস্ব জমি অথবা উল্লিখিত ফ্লোর স্পেস থাকতে হবে। কোনো ভাড়া বাড়িতে কলেজ করা যাবে না। এ ছাড়া ৫০ শিক্ষার্থীর জন্য হাসপাতালে কমপক্ষে ২৫০ শয্যার অবকাঠামো থাকবে এবং নিয়মিত ৭০ শতাংশ শয্যায় রোগী ভর্তি থাকবে।
২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বেসরকারি যেসব মেডিকেলের কলেজ অনুমোদন দেওয়া হয়, তার বেশিরভাগই প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করেনি।
রুহুল হকের সময়কার ওই কর্মকর্তারা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের একেবারে শেষ সময়ে ২০১৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ১২টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়। শিক্ষকসংখ্যা, শিক্ষার মান, আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা সন্তোষজনক নয় বলে রিপোর্ট দেওয়া হলেও, অদৃশ্য ইশারায় অনুমোদন পেয়ে যায় কলেজগুলো। এ কারণে পরবর্তী স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম দায়িত্ব নিয়েই এসব কলেজের অনুমোদন স্থগিত করেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন