সাবেক মুখ্যসচিব নজিবুর রহমান নিজের অনিয়ম-দুর্নীতি ঢাকতে করিৎকর্মা ছিলেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব হিসাবে বদলির সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নথিপত্র, ফাইল নিয়ে যান। এগুলোর মধ্যে সোর্স মানির ফাইলও ছিল। তাই চাকরিকালীন সময়ে কী পরিমাণ অর্থ সোর্স মানি হিসাবে লোপাট করেছেন তার সঠিক তথ্য এনবিআরের কাছে নেই। তবে ওই সময়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) ও শুল্ক গোয়েন্দায় কর্মরত কর্মকর্তাদের ধারণা, সোর্স মানির পরিমাণ হবে ৫-১০ কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সোর্স মানি লুটের টাকা বৈধ করতে ‘প্রটোকল ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক শিষ্ঠাচার’ নামের একটি বই লেখেন নজিবুর রহমান। তাকে এ পরামর্শ দেন তৎকালীন সিআইসির ডিজি বেলাল উদ্দিন। এনবিআরের অধীন কর অঞ্চল, রেঞ্জ ও সার্কেলসহ মোট ৮০৮টি অফিসে এবং ভ্যাট ও শুল্ক বিভাগের মোট ৫৯৬টি অফিসে ন্যূনতম ১০টি করে বই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কিনতে বাধ্য করেন। যার ত ত্ত্বাবধান করেন বেলাল উদ্দিন। আনুকূল্য পাওয়ার জন্য অনেক আয়কর ও কাস্টমস কমিশনার সরকারি ফান্ড থেকে নজিবুর রহমানের বই কেনেন। এই প্রক্রিয়ায় বই বিক্রির সম্মানি বাবদ ৮ কোটি টাকা বৈধ করেন তিনি। এরপর একই কায়দায় তার স্ত্রীর লেখা বইও বিক্রি করেন এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এক কর্মকর্তা অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, নজিবুর রহমানের আবদার, ফরমায়েশ পূরণে প্রধানতম হাতিয়ার ছিল ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প। এ প্রকল্পের অর্থে তিনি সপরিবারে আমেরিকা ভ্রমণ করেন। এ কারণে ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান শতাধিক কর্মকর্তার ভিয়েতনামে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাতিল করে। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় প্রকল্পের টাকায় মতিঝিলের পূর্বাণী হোটেল থেকে অফিস এবং বাসায় কমপক্ষে ১০টি নাস্তার প্যাকেট পাঠানো হতো। যার প্রতিটির মূল্য ৮০০ টাকা করে। দুপুরে কস্তুরী হোটেল থেকে অফিসে ও বাসায় খাবার যেত। উৎসব-পার্বণে সোনারগাঁও হোটেল থেকে খাবার আনা হতো এবং সেই খাবার বাসায়ও পাঠানো হতো। তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক ভয়ে এ অনিয়মের বিষয়ে প্রতিবাদ করারও সাহস পাননি। এসব খরচ প্রকল্পের ফাইলে রক্ষিত আছে বলে দাবি করেন তিনি।
নজিবুর রহমান আটকের পর অনেক কর্মকর্তা তার অন্যায়, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেছেন, নজিবুর রহমানের লেজুড়বৃত্তি না করায় অনেক যোগ্য কর্মকর্তার সঠিক সময়ে পদোন্নতি হয়নি। পদোন্নতির ফাইল আটকে রাখেন। অথচ সিআইসির তৎকালীন মহাপরিচালকের এসিআরে সাবেক অর্থমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট বিরূপ মন্তব্য থাকলেও তাকে এসএসবি সভায় পদোন্নতি প্রদানের জন্য প্রভাব বিস্তার করেন। অনেক ক্ষেত্রেই বহু কর্মকর্তার এসিআর অর্থমন্ত্রীর কাছে না পাঠিয়ে শুধু ফরোয়ার্ডিং (অগ্রায়নপত্র) পাঠাতেন। পরে সেসব কর্মকর্তার এসিআর খুঁজে না পাওয়ায় পদোন্নতি এবং সার্ভিস রেকর্ড সংরক্ষণে অহেতুক জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তার এসিআরে নিজের খেয়াল-খুশিমতো বিরূপ মন্তব্য করেন। ফলে এসব কর্মকর্তা যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও বিরূপ মন্তব্যের কারণে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন। তাছাড়া নজিবুরের ফরমায়েশ খাটতে অপারগতা প্রকাশ করায় বহু কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করার জন্য শৃঙ্খলামূলক বিভাগীয় মামলা চালু করেন তিনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন