বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের দ্বিতীয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ১১টি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সরকারের খরচ ধরা হয়েছে ২৪ হাজার ৪১২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ৭ হাজার ৭৪৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, প্রকল্প ঋণ সহায়তা থেকে ১৬ হাজার ১২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থা থেকে ৬৫৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা নেওয়া হবে।
সোমবার (৭ অক্টোবর) প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা একনেক চেয়ারপারসন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যরা ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবরা উপস্থিত ছিলেন। এরপর রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্পের গাড়ি কোথায় যায় এবং একজন অফিসার কয়টা করে জিপ-গাড়ি ব্যবহার করেন এসব খুঁজে বের করা হবে। এজন্য একনেক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, জেলা উপজেলাসহ সারাদেশে সরকারি যেসব গাড়ি আছে তার একটি তালিকা করা হবে।’
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাব আছে। আমরা এখন বিবিএসের দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিয়েছি। তারা যে হিসাব নিয়ে আসে আমি আইনগতভাবে শুধু সই করা ছাড়া আর কিছুই দেখি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ কম। এদিকে, আমরাও অনেক বেছে ও যাচাই-বাছাই করে প্রকল্প নিচ্ছি। আবার যেসব রাজনৈতিক প্রকল্প আছে, যেগুলোর কিছু এখনও শুরু হয়নি সেগুলো নেওয়া হচ্ছে না। যেসব রাজনৈতিক প্রকল্পের কাজ শেষের পথে সেগুলোর প্রয়োজনীয়তা না থাকলে শেষ করা হচ্ছে। ফলে সরকারি বিনিয়োগও কম হচ্ছে। ফলে অর্থপ্রবাহ কমে গেছে।’
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘আগে রাজনৈতিক নানা কার্যক্রম ছিল। মিছিল, মিটিং সমাবেশ হলে ট্রাক ভাড়া করে লোক আনা হতো। এতে অর্থপ্রবাহ বাড়ত। এখন তো সেসব কার্যক্রম নেই। আমি বলছি না, ফের সেসব চালু করা হবে।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন দুর্নীতি ও চাদাবাজি বন্ধ রয়েছে।’
একনেকে অনুমোদিত প্রকল্পগুলো
একনেকে অনুমোদিত প্রকল্পগুলো হচ্ছে- সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প-২ এলেঙ্গা- হাটিকামরুর-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প। রিজিলিয়েন্ট আরবান অ্যান্ড টেরিটরিয়াল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট। কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর উপর একটি রেল-কাম রোড সেতু নির্মাণ প্রকল্প। মাতারবাড়ি পোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প। এছাড়া সাতটি প্রকল্পের ব্যয় না বাড়িয়ে শুধু মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
একনেক সভায় জানানো হয় ১৯ হাজার ৫৬ কোটির সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প-২: এলেঙ্গা-হাটিকামরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পে ৪২৩ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। সেইসঙ্গে নতুন করে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়। এ প্রকল্পে ১১ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। ব্যয় বাড়ার কারণ হিসেবে ভূমি অধিগ্রহণ, ইউটিলিটি স্থানান্তর ও অন্যন্য খাতে ব্যয় বৃদ্ধি উল্লেখ করা হয়েছে।
নির্বাচিত তিনটি অর্থনৈতিক গ্রোথ করিডোরের অন্তর্ভুক্ত ছয়টি সিটি করপোরেশন ও ৮১টি পৌরসভার জলবায়ু সহনশীল নগর অবকাঠামো উন্নয়ন ও পরিষেবা বাড়াতে ৫ হাজার ৯০১ কোটি টাকা ব্যয়ে রিজিলিয়েন্ট আরবান অ্যান্ড টেরিটরিয়াল ডেভেলপমেন্ট (আরইউটিডিপি) প্রকল্প একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটিতে ৪ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। প্রকল্পে আওতায় ৮৮০ কিলোমিটার নগর সড়ক উন্নয়ন, ২০০০ মিটার ব্রিজ বা কালভার্ট নির্মাণ, ২০০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে বা ফুটপাথ নির্মাণ, ৫৯৫ কিলোমিটার স্ট্রিটলাইট স্থাপন ও অন্যান্য কাজ করা হবে।
চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর রেল-কাম-রোড সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে ১১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে ৭ হাজার ১২৫ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে কোরিয়া। অথচ প্রকল্পটি ২০১৮ সালে ১ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নের জন্য একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়। অর্থাৎ ১০ গুণ ব্যয়ে প্রকল্পটি বৈদেশিক ঋণ নিয়ে অনুমোদন পেয়েছে।
একনেক সভায় মাতারবাড়ী পোর্ট ডেভেলপমেন্ট (২য় সংশোধিত) প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ২৪ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সংশোধনীতে ব্যয় বাড়ছে ৬ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ছে। প্রকল্পটিতে ২০২৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আরও তিন বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে- কক্সবাজার মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশের কার্গো হ্যান্ডলিং ক্ষমতা বৃদ্ধি করে চট্টগ্রাম বন্দরের উপর চাপ কমানোসহ ভবিষ্যৎ্ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চাহিদা মিটানো। প্রকল্পের মাধ্যমে ১ হাজার ২৯১ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন, ৭৬০ মিটার বার্থ নির্মাণ, ৩৯৭ মিটার ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ, সড়ক প্রতিরক্ষাসহ ১৬ দশমিক ৫২৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হবে।
এদিকে, মেয়াদ বাড়ানোর জন্য একনেকে আরও সাতটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। সেগুলো হলো- কুষ্টিয়া জেলায় নতুন সার্কিট হাউস নির্মাণ (১ম সংশোধিত) প্রকল্প, ভুয়াপুর-তারাকান্দি জেলা মহাসড়ক (জেড-৪৮০১) যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ (১ম সংশোধিত) প্রকল্প, বৈরাগীপুল (বরিশাল)-টুমচর-বাউফল (পটুয়াখালী) জেলা মহাসড়ক (জেড-৮-৯১০) যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ (১ম সংশোধিত) প্রকল্প, বরিশাল-ভোলা-লক্ষ্মীপুর জাতীয় মহাসড়কের (এন-৮০৯) বরিশাল (চর কাউয়া) থেকে ভোলা (ইলিশ ফেরিঘাট) হয়ে লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত সড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ (১ম সংশোধিত) প্রকল্প।
কুলাউড়া-পৃথিমপাশা-হাজীপুর-শরীফপুর (জেড-২৮২২) সড়কের ১৪তম কিলোমিটারে পিসি গার্ডার সেতু (রাজাপুর সেতু) নির্মাণ ও ৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্প। এ ছাড়া শিল্প ও শক্তি বিভাগের দুটি প্রকল্প একনেকে মেয়াদ বাড়ানোর জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো- প্রি-পেমেন্ট মিটারিং প্রজেক্ট ফর সিক্স এনওসিএস ডিভিশন আন্ডার ডিপিডিসি (বিশেষ সংশোধিত) এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন: ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন প্রকল্প।
সারাবাংলা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন