জিয়া পরিবারকে ‘দুর্নীতিবাজ’ প্রমাণে প্রধান বরকন্দাজের দায়িত্ব পালন করেছিলো দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাই তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কথিত ‘এতিমের টাকা চুরি’র অপবাদ দেয়া হয়। দুদক-বিচার বিভাগ-হাসিনা সমন্বিত আক্রমণ করে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পরিবারের ওপর সীমাহীন জুলুম-নিপীড়ন চালায়। পরিবারের প্রতিটি সদস্য,আত্মীয়-স্বজন এমনকি বন্ধু-বান্ধবদের গায়েও ‘দুর্নীতিবাজ’ কালিমা লেপনের অব্যর্থ চেষ্টা চালায়। আপসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বিনা চিকিৎসায় কারাপ্রকোষ্ঠে ফেলে রাখে বছরের পর বছর। তিনবারের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দায়ের করে জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্ট, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা,নাইকো-গ্যাটকোসহ ৩৭টি মিথ্যা মামলা। এর মধ্যে জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে কারাদণ্ড দেয় শেখ হাসিনার আদালত। কথিত অর্থ পাচারের মামলায় তারেক রহমানকে সাজা দেয়া হয়। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ছোট ছেলে আরাফাত (বর্তমানে মৃত) রহমান কোকোর বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলা থেকে বাদ যাননি রাজনীতি থেকে দূরে থাকা চিকিৎসক গৃহিনী ডা: জোবায়দা রহমান। তারেক রহমানের শাশুড়ি সৈয়দা ইকবালমান্দ বানুকেও আসামি করা হয় মামলার। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন কেউ বাদ যায়নি শেখ হাসিনার রোষানল থেকে। কিন্তু ১৮ বছর ধরে জিয়া পরিবারের প্রতি মহাপরাক্রমশালী হিসেবে নির্যাতনের স্টিমরোলার চালানো দুদক এখন এ কী কথা বলছে! গত দেড়যুগ ধরে লুটতরাজের মাধ্যমে যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করেছে, সেগুলোর নাকি কোনো হদিসই পাওয়া যাচ্ছে না ! যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়েছে-মর্মে নিশ্চিত হওয়া গেছে, সেসব দেশ নাকি এ সংক্রান্ত কোনো তথ্যই দিচ্ছে না! তথ্য-উপাত্তগত সহযোগিতা চেয়ে ৭১টি দেশে মিউচুয়াল লিগ্যাল এসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠালেও-সহযোগিতা করছে না অধিকাংশ দেশ। তথ্য চেয়ে বার বার চিঠি দেয়া হলেও জবাব এসেছে মাত্র ২৭টি দেশ থেকে। বরং কোনো কোনো দেশ উল্টো দুদকের কাছে ‘কয়েরিজ’ দিয়ে পাঠিয়েছে।
গত ১ অক্টোবর সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) প্রতিনিধি দল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেড অব ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন মিশেল ক্রেজা, প্রোগ্রাম ম্যানেজার অব ইনক্লুসিভ গভর্নেন্স পাবলো পাদিন প্যারেজ, নাদের তানজা এবং কিশোয়ার আমিন ছিলেন প্রতিনিধি দলে। দুদক অংশে ছিলেন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ,দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন, মহাপরিচালক মো: আক্তার হোসেন,পরিচালক আব্দুল্লাহ আল জাহিদ ও পরিচালক (লন্ডারিং) গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী। এ ম্যারাথন বৈঠকে ইইউ মূলত: দুদক তার দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম চালাতে কী ধরণের সমস্যায় পড়ছে জানতে চায়। কী ধরণের সহযোগিতা ইইউ দিতে পারে জানতে চায় সেটিও। জবাবে দুদক ‘প্রধান সমস্যা’ হিসেবে জানিয়েছে, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অসহযোগিতার কথা। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত জানতে চাইলে ‘ইউনাইটেড ন্যাশন্স কনভেনশন এগেনস্ট করাপশন’ (আনকাক) স্বাক্ষরকারী দেশগুলোও কোনো সাড়া দিচ্ছে না বলে জানান দুদকের শীর্ষ কর্মকর্তারা। তবে দুদকের এই অসহায় আর্তনাদ কতটা সত্য আর কতটা মেকী- সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিদগ্ধ জনেরা। এখন কোথায় গেলো দুদকের হুঙ্কার ? কোথায় গেলো ধারা-উপধারা এবং ‘আইনের শাসন’ ? কোথায় গেলো সেই শক্তিমত্তা-দুদক যা বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান,ডা: জোবায়দা রহমান এবং মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর ক্ষেত্রে দেখিয়েছিলো ? শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়,পুতুল, তারেক সিদ্দিকী,আজিজ খান,ফারুক খান, জাবেদ চৌধুরী,বিপু,এস.আলম, সামিট গ্রুপের মতো হাজার হাজার ব্যাংক লুটেরার পাচার করা বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ ফেরত আনার পালা যখন এলো-তখন দুদক কেন কাতর, দুর্বল এবং ন্যূব্জ ? কেন এই অপারগতা ? কিসের এতো সীমাবদ্ধতা ?
পক্ষান্তরে হাসিনার পুরো শাসনকাল জুড়ে ‘কোকোর পাচার করা অর্থ ফেরত আনা’র হয়েছে-মর্মে বাজানো হয়েছে একই ভাঙা ঢোল । সেই ঢোল পেটানোর ক্ষেত্রে কত শক্তি-মত্তারই না পরিচয দিয়েছিলো দুদক। অথচ কেমন করে, কোন্ আইনে, কত টাকা ফেরত আনা হয়েছে, আদৌ কোনো অর্থ ফেরত আনা হয়েছিলো কি না, ‘ ফেরত আনা অর্থ’ দুদক কোথায় রাখা হয়েছে ? পাচার হওয়া আর কারো অর্থ ফেরত আনা হয়েছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাব প্রতিষ্ঠানটিকে কখনো দিতে হয়নি। এখন দুদকের অনেক সিনিয়র কর্মকর্তাকেই বলতে শোনা যায়, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা নাকি দুদকের কাজ নয় ! দুদকের নাকি তেমন কোনো এখতিয়ারই নেই! যদিও বিগদ্ধজনেরা মনে করছেন, সংস্থাটির আসল রোগ সেখানে নয়। আসল রোগ হচ্ছে, সদিচ্ছায়। বর্তমান কমিশন শেখ হাসিনা এবং তার পারিষদের পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে চায় না। ফেরত আনবেও না। কারণ, অর্থ যখন পাচারের সঙ্গে সংস্থাটি নিজেই সংশ্লিষ্ট। হাসিনা এবং তার পারিষদ যখন ঋণের নামে একের পর এক ব্যাংক লুট করছে,আমদানি-রফতানির আড়ালে আন্ডার ইনভয়েস-ওভার ইনভয়েস করে দেদারসে টাকার পাচার করেছে-দুদক তখন অন্ধ ছিলো। মুদি দোকানদার, সরকারি অফিসের কেরানি, ভূমি অফিসের উমেদার, এলএলএসএস’র ‘অবৈধ সম্পদ’ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো দুদক। ‘দমন’র পরিবর্তে ব্যস্ত থেকেছে ‘প্রতিরোধ’মূলক আরামদায়ক বিষয় নিয়ে। দুদক কর্মকর্তাদের ব্যস্ত রাখা হয়েছে ‘নোটিশ বাণিজ্য’ দিয়ে।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে একাধিক সিনিয়র কর্মকর্তা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানান, শেখ হাসিনার আমলে পাচার হওয়া অর্থ বিদ্যমান আইনেই ফেরত আনা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দুদকের আন্তরিকতা। তবে ‘কোকোর টাকা’ ফেরত আনার মতো ‘পলিটিক্যাল রেটরিক’ সৃষ্টির জন্য বেআইনিপন্থা অবলম্বন করে নয়। দুদকের আইনে যে ব্যপকভিত্তিক ক্ষমতা রয়েছে সেটি প্রয়োগের মাধ্যমেই পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এর সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন,এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ‘এফবিআই’র সার্বিক সমর্থন যদি মেলে-বিদ্যমান আইন এবং কর্মকর্তাদের দিয়েই হাসিনার দস্যুবৃত্তির অর্থ ফেরত আনা যেতে পারে। অভিজ্ঞ এই কর্মকর্তারা জানান, মূলত: শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পরিবারকে অপদস্ত করার উদ্দেশ্যেই আরাফাত রহমান কোকোর অর্থ ফেরত আনার ড্রামা সাজানো হয়। শেখ হাসিনার অনুগত আমলা গোলাম রহমান ‘অক্টোখান’ নামক একটি সিএ ফার্মের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন কোকোর অর্থ ফেরত আনার জন্য। যদিও স্বশাসিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান দুদক আইনত: এ ধরণের ব্যক্তিগত কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতে পারে না। বিনা টেন্ডারে অক্টোখানকে ওই কার্যাদেশ দিয়ে তৎকালিন কমিশন নিজেই ৫(২) ধারায় (ক্ষমতার অপব্যবহার) অপরাধ সংঘটন করেছিলো। আত্মসাতের অভিযোগও আনা যায়। কারণ শুধুমাত্র তথ্য আনার পরামর্শক ফি হিসেবে দুদক ‘অক্টোখান’র মালিক ফেরদৌস আহমেদ খান সাড়ে ৩ কোটি টাকা পরিশোধ করে। পরবর্তীতে ‘এমএলএআর’ পাঠিয়ে আরো অর্থ দাবি করেন তিনি। পরবর্তীতে জানা যায়, এটি ছিলো লুটেরা শেখ হাসিনার তৎকালিন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের ‘উপুরি’ রোজগারের খাত। তৎকালিন দুদক চেয়ারম্যান মো: বদিউজ্জামানের হাতে ফেরত আনা ‘কোকোর টাকা’র প্রতীকি চেকও আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেন মাহবুবে আলম। ওই অনুষ্ঠানে দাবি করা হয় তিন দফায় কোকোর ১৩ কোটি টাকা নাকি সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত এনেছে দুদক। সংস্থাটির অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা জানান, এসবই ছিলো ভেল্কিবাজি। তারা মনে করেন, যে প্রক্রিয়ায় কোকোর টাকা আনা হয়েছে মর্মে দাবি করা হয়েছে- একই কায়দায় আনা যাবে হাসিনার পাচার করা অর্থ। সেই পন্থা তখন সফল হলে এখন ব্যর্থ হবে কেন? নাকি জিয়া পরিবারকে হেয় করার লক্ষ্যেই করা হয় পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার নাটক ? সেটি হয়ে থাকলে, এই নাটক যারা মঞ্চায়ন করেছেন, এখন তাদেরকে আইনের আওতায় আনা জরুরি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন