চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ টানেল। প্রকল্পের সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, টানেল দিয়ে দৈনিক গাড়ি চলবে ২০ হাজারেরও বেশি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, চালুর একবছরের মাথায় এসে টানেল দিয়ে প্রতিদিন গাড়ি চলছে গড়ে তিন হাজারের মতো। ফলে টানেলের দৈনন্দিন পরিচালনা ব্যয় তুলতেই হিমশিম খাচ্ছে সেতু কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। টানেল থেকে আয় কম হওয়ায় ঋণ পরিশোধে ভর্তুকি দিতে হবে সরকারকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমীক্ষার গলদ ও দূরদর্শিতার অভাবে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে হওয়া টানেল এখন বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রামকে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ হিসেবে গড়ে তোলা। টানেল দিয়ে বাইসাইকেল, সিএনজি ও মোটরসাইকেল পারাপার করতে দেওয়া হচ্ছে না। গণপরিবহনেরও সংখ্যা কম। আবার টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে এখনও তেমন কোনো শিল্পকারখানাই হয়নি। ফলে যান চলাচল বাড়ছে না।
সেতু কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, টানেল দিয়ে এখন পর্যন্ত দিনে গড়ে প্রায় তিন হাজার যানবাহন চলাচল করছে। অথচ চীনা ঠিকাদারের সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, ২০২০ সালে টানেল চালু হলে দিনে ২০ হাজার ৭১৯টি যানবাহন চলবে, যেটা প্রতি বছর ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বাড়বে। ২০২৫ সালে দৈনিক গড়ে ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলবে। ২০৩০ সালে সংখ্যা দাঁড়াবে দিনে প্রায় ৩৮ হাজারে।
টানেলের নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে জানান, গাড়ি চলাচল আগের চেয়ে কমেছে। শুরুতে অনেকেই টানেল দেখতে ও ঘুরতে আসতেন। এখন সে চাহিদাও কমেছে। টোল থেকে যে আয় হচ্ছে সেটা দিয়ে ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা দৈনন্দিন ব্যয় তোলাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের মূল দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এটা দেশের নদীর তলদেশের প্রথম টানেল। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর টানেলটির উদ্বোধন করা হয়। চীনা ঋণ ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে এ টানেল তৈরি করা হয়েছে।
টানেল তৈরিতে ব্যয় হয় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। নির্মাণের শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৪৪৬ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা। পরে তা বেড়ে ১০ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৪২ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ সুদে ৫ হাজার ৯১৩ দশমিক ১৯ কোটি টাকা দিয়েছে। বাকি টাকা দেয় বাংলাদেশ সরকার।
সেতু কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল করেছে ৯১ হাজার ৯২৫টি। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে যানবাহন চলাচল করেছে তিন হাজার ৬৪টি। এতে আয় হয়েছে দুই কোটি ৫১ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে গড়ে প্রতিদিন আয় ৮ লাখ ৩৯ হাজার টাকার বেশি। এ হিসাবে গত প্রায় ১১ মাসে টানেল দিয়ে প্রতিদিন গাড়ি চলাচল করেছে তিন থেকে চার হাজারটি।
উদ্বোধনের পরের মাস গত বছরের নভেম্বরে টানেলে গাড়ি চলাচল করেছে এক লাখ ৬৬ হাজার ৩১২টি। অর্থাৎ ওই মাসে প্রতিদিন গাড়ি চলেছে পাঁচ হাজার ৫৪৪টি। এতে আয় হয়েছে তিন কোটি ৯৪ লাখ ৪২ হাজার ৩০০ টাকা। এ হিসেবে ওই মাসে গড়ে প্রতিদিন আয় হয়েছে ১৩ লাখ ১৪ হাজার ৭৪৩ টাকা। এরপর ডিসেম্বরে গাড়ি চলেছে এক লাখ ৯৩ হাজার ৪২১টি। অর্থাৎ, প্রতিদিন চলেছে ছয় হাজার ২৩৯টি যানবাহন। এদিকে, চলতি বছর এপ্রিলে গাড়ি চলাচল করেছে এক লাখ ১৫ হাজার ৬৪৮টি। এ হিসেবে দৈনিক গাড়ি চলেছে তিন হাজার ৮৫৫টি।
জানা গেছে, উদ্বোধনের পর টানেলে যেসব যানবাহন চলাচল করেছে তার বেশিরভাগই ব্যক্তিগত গাড়ি। গণপরিবহন এ টানেল দিয়ে তেমন চলাচল করছে না বলা যায়। এছাড়া উচ্চতা কম হওয়ায় ভারী কার্গোর মতো যানবাহন চলাচল বিঘ্ন হচ্ছে। আবার নিরাপত্তাজনিত কারণে দাহ্য পদার্থসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ থাকায় সবধরনের গাড়ি টানেল দিয়ে চলাচল করতে পারে না। মোটরসাইকেল ও তিন চাকার গাড়ি এবং সিএনজিচালিত অটোরিকশা টানেলেও চলতে দেওয়া হয় না। যেসব গাড়ি টানেল দিয়ে চলে তার বেশিরভাগই পর্যটকবাহী।
সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু টানেল থেকে প্রতিদিন টোল বাবদ গড়ে আট থেকে নয় লাখ টাকা আয় হচ্ছে। আর টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ দিনে ব্যয় হচ্ছে গড়ে সাড়ে ৩৭ লাখ টাকার বেশি। অর্থাৎ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রতিদিন ২৯ লাখ টাকার বেশি লোকসান হচ্ছে। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত গত ১১ মাসে ৮৩ কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে।
এদিকে, নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চীনের কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে (সিসিসিসি) পাঁচ বছরের জন্য টানেল রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের দায়িত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। তাদের দিতে হবে ৯৮৪ কোটি টাকা (৩৫ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রায়)।
জানা গেছে, ঠিকাদারকে যে টাকা দেওয়া হবে, এর মধ্যে ৩০০ কোটি টাকার মতো ব্যয় হয়েছে তাদের স্ক্যানার কিনতে। রক্ষণাবেক্ষণে পাঁচ বছরে প্রকৃত ব্যয় ৬৮৪ কোটি টাকা। সে হিসেবে রক্ষণাবেক্ষণের দৈনিক ব্যয় দাঁড়ায় সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ টোল থেকে যে অর্থ আয় হচ্ছে, তা রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের তিন ভাগের এক ভাগ।
এ ছাড়া, প্রতি পাঁচ বছর পর একবার টানেলের বড় ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে, যাকে বলা হয় ‘রেগুলার মেইনটেন্যান্স’। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, একবার এ ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ কাজে প্রায় ১৯ লাখ ডলার ব্যয় করতে হবে, যা প্রায় ২৩ কোটি টাকার সমান।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথম থেকেই টানেল করার বিরোধিতা করেছিলাম। ২৬৫ বছরেও এ টানেলের নির্মাণ ব্যয় উঠবে না। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে। প্রথমদিন থেকেই নদীর তলদেশে নির্মাণ করা এ টানেল দেশের অর্থনীতির ওপর একটি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা না করে নদীর উজানের দিকে চার-পাঁচটি সেতু নির্মাণ করলে অন্তত কয়েক লাখ মানুষের দুর্ভোগ কমতো।’
টানেলকে বাহাদুরি দেখানোর প্রকল্প আখ্যা দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘এ টানেল স্ট্যান্ডবাজি দেখানোর জন্য করা হয়েছে। নিজেদের বাহাদুরি দেখাতে এ প্রকল্প করা হয়েছে। টানেল নির্মাণে দূরদর্শিতার অভাব ছিল।’
সম্মিলিত নাগরিক ফোরাম চট্টগ্রামের সহ-সভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘টানেল দিয়ে গাড়ি কেন চলবে? নদীর দক্ষিণ পাড়ে তো কোনো উন্নয়ন হয়নি। কোনো দূরদর্শিতা ছাড়াই এটার ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়েছে। যারা এটার ফিজিবিলিটি স্টাডি করেছে আগে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হোক। টানেলের দৈনন্দিন ব্যয় পদ্মা সেতুর চেয়ে অনেক বেশি। টানেলের এক কিলোমিটারে যে খরচ হয়েছে সেটা দিয়ে পুরো চট্টগ্রাম শহরের রাস্তাগুলোর কাঠামোগত উন্নয়ন করা যেত।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্ট্যাটাস সিম্বল দিয়ে কোনো দেশ চালানো যায় না। টানেল এখন দেশের মানুষের জন্য বোঝা। শার্ট-প্যান্ট নেই, আমরা টাই পড়ে আছি। টানেলের অবস্থাও ঠিক সেরকম। এক টানেলের নির্মাণ ব্যয় দিয়ে কর্ণফুলী নদীর ওপর একাধিক সেতুসহ চট্টগ্রামকে আরও সুন্দরভাবে সাজানো যেত।’
সারাবাংলা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন