শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে গত ১৫ বছর যেভাবে পুঁজিবাজার পরিচালিত হয়েছে একে শেয়ারের দামে কারসাজির সহায়ক হিসেবে আখ্যা দেওয়া যেতে পারে।
শেয়ারের সিরিয়াল ট্রেডিংসহ এ ধরনের কারসাজি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
দুঃখজনক বিষয় হলো—ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কারসাজিতে জড়িয়ে পড়ে। এটি আগে দেখা যায়নি।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার ঢিলেঢালা নজরদারি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অভাবে অনেক বিনিয়োগকারী তাদের কষ্টার্জিত টাকা পুঁজিবাজারে হারিয়ে শেষ পর্যন্ত শেয়ারব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন।
ভালো শেয়ার কেনার পরও কমপক্ষে চারটি স্টক ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগকারীদের টাকা আত্মসাৎ করায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
প্রায় ৭০টি ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানও বিনিয়োগকারীদের টাকা আংশিক আত্মসাৎ করেছে বলে জানা গেছে।
সবচেয়ে নিরাপদ মিউচুয়াল ফান্ডও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কারণ বেশ কয়েকটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান নজিরবিহীনভাবে মিউচুয়ার ফান্ডের টাকার অপব্যবহার করেছে। যদিও তারা এসব বিনিয়োগ সুরক্ষা ও ভালোভাবে পরিচালনার জন্যই নিযুক্ত হয়েছিল।
বিশ্লেষকরা এ অবস্থার পেছনে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নজরদারির অভাব ও নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে কারসাজির বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা না থাকাকে দায়ী করেছেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বেশ কয়েকটি শেয়ারের মূল্য কারসাজি করায় ২০২২ সালে বিএসইসি মাত্র ২১ কোটি টাকা জরিমানা করেছিল। যেখানে শেয়ার জালিয়াতকারীদের ২৫৩ কোটি টাকা হাতিয়েছিল।
২০২৩ সালে শেয়ারের দাম কারচুপির দায়ে দুই কোটি টাকা জরিমানা হলেও কারচুপিকারীদের মুনাফা হয়েছিল ১৫ কোটি টাকা। গত ১৫ বছর ধরে একই পরিস্থিতি দেখা যায়।
শেয়ারের কারসাজিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পৃক্ততা বছরের পর বছর ধরে বেড়েছে। তৈরি হয়েছে আস্থার সংকট। এটি পুঁজিবাজারের জন্য অশনিসংকেত।
২০২১ সালের আগে দুই-একটি প্রতিষ্ঠান শেয়ারের দাম কারসাজিতে জড়িত ছিল বলে প্রমাণিত হলেও ২০২২ সালে তা ১৫ ছাড়িয়ে যায়। ২০২৩ সালে ছয় প্রতিষ্ঠান কারসাজির সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণিত হয়।
বিএসইসি এত ধীরে তদন্ত চালায় যে কারসাজিকারীরা বাজার ছেড়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পান।
যেমন, ইউনিভার্সাল ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশনের (ইউএফএস) কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মিউচুয়াল ফান্ড থেকে প্রায় ১৮০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পেয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
এর তদন্ত চলেছিল চার মাস। জড়িতরা পালিয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিলেন।
তহবিল পরিচালকদের হাতে বিনিয়োগকারীদের টাকার অপব্যবহারের এটি একমাত্র উদাহরণ নয়।
ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী শহিদুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপকহারে শেয়ারের দামে কারসাজির কারণে অনেক বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে পুঁজিবাজার ছেড়ে চলে গেছেন।'
দেশের অর্থনীতিতে গড়ে ছয় শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলেও তা পুঁজিবাজারে ঢোকেনি।
জবাবদিহিতার অভাব থাকায় ও বিএসইসি কারসাজিকারীদের জরিমানা হিসেবে নগণ্য পরিমাণ অর্থ আরোপ করায় পুঁজিবাজারে কারসাজি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়।
শহিদুল ইসলাম আরও বলেন, 'বিনিয়োগকারীরা দেখেছেন যে বিভিন্ন রোড শোতে আমন্ত্রণ পাওয়া বিএসইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শেয়ার কারসাজিকারীদের সঙ্গে একসাথে চলাফেরা করেছেন। তাই বিএসইসি কারসাজি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে।'
এমনও দেখা গেছে—দুর্বল অনেক প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দিয়েছে বিএসইসি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা কারসাজিকারীদের এসব কোম্পানির শেয়ারের দামে কারসাজির 'অনুমতি' দিয়েছে যাতে শেয়ারের দাম বেড়ে যায় ও আইপিও অনুমোদনের যৌক্তিকতা পায়।
সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রায় ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত চার ব্রোকারেজ হাউস—বানকো সিকিউরিটিজ, ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ, তামহা সিকিউরিটিজ ও শাহ মোহাম্মদ সগীর অ্যান্ড কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায়।
অন্তত ৬৮ ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনৈতিকভাবে গ্রাহকদের প্রায় ৪৩০ কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে।
বিএসইসি বেশ কয়েকটি ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) প্রতিষ্ঠানকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের মূল পর্ষদে ফেরার অনুমতি দিয়েছে, যেখানেও বিএসইসি সঠিক নিয়ম মানেনি বলে অভেোযগ রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল মিলস, বাংলাদেশ মনোসপুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি, পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস ও মুন্নু ফেব্রিক্স।
নিয়ম না মানায় গত ১০ বছর ধরে ওটিসি মার্কেটে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনাবেচা হচ্ছে।
এজ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী আলী ইমাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিয়ম-নীতির যথাযথ প্রয়োগের অভাব গত ১৫ বছরে কারসাজিতে ইন্ধন জুগিয়েছে।'
নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যকারিতা নিয়ে আপস করা হয়েছিল। কারসাজিকারীদের শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে কোনো রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল না। তাছাড়া কারসাজিকারীরা কারসাজির মাধ্যমে পাওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে প্রভাবিত করতে ব্যবহার করে।
তার ভাষ্য, 'কারসাজির কারণে পেশাদারিত্ব, প্রতিযোগিতা ও বাজারের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে।'
কারসাজিকারীরা বিনিয়োগকারীদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে তারা তিন মাসের মধ্যে তাদের টাকা দ্বিগুণ করবেন ও পেশাদার তহবিল পরিচালকরা দীর্ঘ সময় ধরে বিনিয়োগ ধরে রাখার পর বিনিয়োগকারীদের প্রায় ১৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ বার্ষিক মুনাফা দেবেন।
আলী ইমাম আরও বলেন, 'শেয়ারের দাম কারসাজির উদ্দেশ্যে লেনদেনের কারণে মানুষ শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাজারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এখন তারা বিশ্বাস করেন যে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলে তাদের টাকা হারিয়ে যাবে।'
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন