লবণ আমদানি নয়, উদ্বৃত্ত লবণ রফতানির লাখ্য নিয়ে আগাম মাঠে নামছেন ৫০ হাজার লবণচাষি। স্বনির্ভর লবণখাতের উন্নয়ন ও লবণচাষিদের জীবনমান উন্নয়নে ১১ দফা দাবি আদায়ে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তারা।
আজ বুধবার সকালে কক্সবাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে লবণচাষি কল্যাণ সমিতির নেতৃবৃন্দ এই দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে জানানাো হয়, বাংলাদেশে শুধুমাত্র কক্সবাজার জেলায় ৯০ শতাংশ ও ১০ শতাংশ চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার মোট নয় শ’ বর্গ কি.মি. উপকূলীয় এলাকায় লবণ উৎপাদন হয়, যা দিয়ে দেশের লবণের চাহিদা পূরণ করা হয়ে থাকে। লবণ উৎপাদন হতে ভোক্তার হাত পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ মানুষ এই শিল্পের সাথে জড়িত এবং এই লবণ শিল্প জিডিবিতে প্রায় ১০ ভাগ অবদান রেখে আসছেন।
কক্সবাজার জেলা এবং বাঁশখালীতে প্রায় ৫০ হাজার লবণচাষিসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ্যভাবে ওই এলাকার প্রায় তিন লাখ মানুষ লবণ উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল এবং ওই অঞ্চলের আর্থসামাজিক মর্যাদা নির্ভর করে লবণ চাষের ওপর। ১৫ দিন পরে লবণ মৌসুম শুরু হচ্ছে। ৫০ হাজার লবণচাষি আগামা মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
২০১১ সালে জাতীয় লবণনীতি প্রণয়ন করা হয়। সে সময় সংশ্লিষ্ট সবাই মিলে দেশে লবণের যে চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছিল তা যুক্তিযুক্ত। তারপর ২০১৬ হতে ২০২০ পর্যন্ত সময়ে দেশে পর্যাপ্ত লবণ উৎপাদন হওয়ার পরও মিথ্যা তথ্য দিয়ে নানা অজুহাতে ঘাটতি দেখিয়ে অসাধু ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা ভারত থেকে লবণ আমদানি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে দেশীয় স্বনির্ভর লবণশিল্পকে ধ্বংস করে ভারতীদের তাবেদার বানানোর চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। এখন আবারো ফ্যাসিবাদের দোসর সেই চোরাচালান চক্রটি কৌশনে লবণ আমদানি চক্রান্ত শুরু করেছে।
লবণচাষিদের নানাভাবে প্রতিবাদে বিগত সরকার লবণ আমদানিতে বিধি-নিষেধ আরোপ করার ফলে ওই অসাধু লবণ আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের প্ররোচনায় বা মিথ্যা তথ্যের আলোকে বিগত সরকার ২০২২ সালে জাতীয় লবণনীতি প্রণয়ন করার সময় দেশে লবণের চাহিদা অতিরিক্ত দেখানো হয় অর্থাৎ ২০২৪ সালে ২৫.২৮ লাখ মে. টন। বিভিন্ন হিসাব মতে, ২২ লাখ মে. টনের বেশি হওয়ার কথা নয়।
জাতীয় লবণনীতি ২০১১ বা ২০১৬-এর আলোকে ২০২২ সালের শুধুমাত্র শিল্পখাতে লবণের চাহিদা হয় ৪.৬০ লাখ মে. টন। কিন্তু জাতীয় লবণনীতি ২০২২ অনুযায়ী, তা হলো ৬.৯২ লাখ মে. টন এবং এখানে আরো উল্লেখ্য যে ২০১১ সালের নীতিতে ৫ শতাংশ বৃদ্ধি ধরা হলেও ২০২২ সালের লবণনীতিতে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি ধরা হয়েছে, যা অসম্ভব। অর্থাৎ ২০২৪ সালের শিল্পখাতে চাহিদা ১০.২০ লাখ মে. টন (প্রসেস লসসহ) এবং ২০২৫ সালে তা বৃদ্ধি হয় ১১.৮২ লাখ মে. টন। বাস্তবতা হলো এই খাতে চাহিদা কোনোক্রমেই ৭.০০ লাখ মে. টনের বেশি নয়।
বিসিকের হিসাব অনুযায়ী, সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে অর্থাৎ ৬৩ বছরের মধ্যে ২০২৩-২৪ লবণ মৌসুমে লবণচাষিরা সর্বোচ্চ ২৪.৩৮ লাখ মে. টন লবণ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু চাহিদা অতিরিক্ত থাকায় তা স্পর্শ করতে পারেননি। উৎপাদন চাহিদা ২৫.২৮ লাখ মে. টন হতে ০.৯০ লাখ (৯০ হাজার) মে. টন কম। চাহিদার যে হিসাব তা সঠিক নয় বলে তারা মনে করেন।
নির্ধারিত চাহিদা অনুযায়ী, চলতি বছর নয় মাসে ১৯ লাখ মে. টন লবণ ব্যবহার হওয়ার কথা। সে আলোকে পাঁচ লাখ মে. টন লবণ মজুদ থাকার কথা নয় (কারণ গত বছরের কোনো লবণ মজুদ ছিল না)। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ২৩ সেপ্টেম্বর বিসিকের হিসাব অনুযায়ী লবণ মাঠে ৭.৭৮ লাখ মে. টন এবং মিল পর্যায়ে ২.৩৬ লাখ মে. টন মোট ১০.১৪ লাখ মে. টন লবণ মজুদ আছে। বাস্তবতায় তার পরিমান আরো বেশি। মাঠ পর্যায়ে লবণ বেচা-কেনাও অনেক কম, দামও গত বছরের চেয়ে মণপ্রতি প্রায় দুই শ’ টাকারও কম। এই বিক্রয় মূল্যে উৎপাদন খরচ তোলাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আমরা লবণচাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। আগামী নভেম্বর মাসে নতুন লবণ উৎপাদন করার জন্য মাঠ প্রস্তুতিতে যেতে হবে। কিন্তু এতো মজুদ লবণ নিয়ে আমরা বিপাকে আছি। পাশাপাশি আর্থিকভাবেও অনটনের মধ্যে আছি।
এমন পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত লবণ বিদেশে রফতানির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাতে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা আসবে, অন্যদিকে চাষিরাও লবণের ন্যায্য মূল্য পাবে।
লবণচাষিরা বলেন, আমাদের দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল একটি লবণ বোর্ড গঠন করার। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুলা ঝুলানোর মত লবণ উপদেষ্টা বোর্ড গঠন করেছেন, যা দিয়ে লবণশিল্পের কোনো কাজই হয়নি। এই জন্য মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার নিকট আকুল আবেদন লবণ এবং লবণচাষিদের জীবনমান উন্নয়নে আমাদের ১১ দফা দাবি বাস্তবায়ন করুন।
লবণচাষিদের ১১ দফা দাবি
১) লবণচাষিদের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি ও আগামীতে আরো বেশি লবণ উৎপাদন করার উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্য অতি দ্রুত কমপক্ষে ৩.০০ লাখ মে. টন লবণ রফতানি ব্যবস্থা করতে হবে।
২) লবণের উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য বৈদ্যুতিক মোটরের ব্যবহার সহজলভ্য করা, জমির লিজমানি কমানো এবং প্রকৃত প্রান্তিক লবণচাষিকে সরকারের খাস জমি বরাদ্দ প্রদানের পদক্ষেপ গ্রহণ করাতে হবে।
৩) অসুস্থ ও দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় মাঠ পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্থ লবণচাষিদের সরকার কর্তৃক চিকিৎসা ও পুর্নবাসন নিশ্চিত করতে হবে।
৪) বর্ষা মৌসুমে প্রান্তিক লবণচাষিদের ১০ টাকা কেজি মূল্যে প্রতিমাসে ৩০ কেজি করে চাল বরাদ্দ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫) বিসিকের মাধ্যমে আধুনিক পদ্ধতিতে লবণ চাষে প্রকৃত লবণচাষিদের উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থাগ্রহণ এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৬) দেশে লবণের খাত ভিত্তিক চাহিদা নিরুপণের জন্য পূর্ণাঙ্গ জরিপ করে জাতীয় লবণ নীতি- ২০২২ এর সংশোধন করতে হবে।
৭) জরিপের মাধ্যমে লবণ জমির পরিমাণ চিহ্নিত করাসহ লবণচাষিদের পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরি করে প্রত্যেককে আইডি কার্ড প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৮) অল্প জমিতে অধিকতর, পরিপক্ক, দানাদার ও গুনগত মানসম্পন্ন লবণ উৎপাদন এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে লবণ গবেষণা ইনস্টিটিউট ও লবণচাষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।
৯) লবণচাষিদের নামমাত্র নয়, বাস্তবিকভাবেই সহজ শর্তে ব্যাংক বা অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থাগ্রহণ এবং প্রান্তিক লবণচাষিদের স্বল্পমূল্যে লবণ উৎপাদনের উপকরণ (পলিথিন ও জ্বালানী) সরবরাহ করতে হবে।
১০) জাতীয় লবণনীতি অনুযায়ী সরকারিভাবে এক লাখ মে. টন লবণের বাফার স্টক গড়ে তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১১) নামমাত্র লবণ উপদেষ্টা বোর্ড নয়, লবণশিল্পের নিবিড় তদারকির জন্য পৃথক লবণ বোর্ড গঠন করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে ১১ দফা মেনে নিয়ে অসহায় দরিদ্র লবণচাষিদের জীবন-মানের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান তারা। অন্যথায় অবহেলিত অসহায় লবণচাষিরা একাত্রিত হয়ে বৃহত্তর আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করার ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে বলে হুঁশিয়ারি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কক্সবাজার জেলা লবণচাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট শাহাব উদ্দিন।
বক্তব্য রাখেন কক্সবাজার জেলা লবণচাষি কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম হাসান, এজেএম গিয়াস উদ্দিন, জাফর আলম জফুর, আরিফ উল্লাহ সিকদার, মো: শরীফ, নুরুল হোসাইন, এখলাছুর রহমান, আবুল কাশেম, একরাম উদ্দিন চৌধুরী, মো: হাবিবুল মতিন, ডা. নুরুল ইসলাম মনি, ডাক্তার সোহেল, সাইফু ইসলাম বাবলু ও নিজামুদ্দিন উজ্জলসহ লবণচাষি নেতৃবৃন্দ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন