ফরাসিরা মদ আর ক্যাভিয়ার (মাছের ডিম) নিয়ে গর্ব করে। জার্মানদের গর্ব প্রকাশের মূলধন বিয়ার ও সস। এদিক থেকে ইংলিশরা বাঙালির অনেক কাছাকাছি। কারণ মাছ আর পিচ তাদের পছন্দের খাবার।
আর দুই বাংলার জনগোষ্ঠী দারুণ ইলিশপ্রিয়।
ইতিহাসে রয়েছে, বাদশাহ মুহাম্মদ বিন তুঘলক ইলিশ খেয়ে ডিহাইড্রেশনে ভুগে মারা যান। সিন্ধু নদে ভ্রমণকালে জেলেদের কাছে চকচকে ইলিশ দেখে তিনি তা খেতে চান। পারিষদ তাঁকে বলে, “এ ‘আকাশগঙ্গা’ মাছ সবার পেটে সয় না হুজুর।
” কিন্তু তুঘলক শেষ পর্যন্ত ইলিশ খান এবং তিন দিনের টানা নিম্নচাপ সইতে না পেরে ভবলীলা সাঙ্গ করেন। তখন দক্ষিণ ভারতের লোকজনের বিশ্বাস ছিল, আকাশপথেই গঙ্গার ইলিশ মাঝেমধ্যে সিন্ধু নদে গিয়ে পড়ে। তাই এটা ‘আকাশগঙ্গা’ নামে পরিচিতি পায়।
ইলিশের বৈজ্ঞানিক নাম হিলসা ইলিশ।
১৮২২ সালে হ্যামিলটন বুকানন বঙ্গোপসাগরের মাছ নিয়ে গবেষণার সময় ইলিশ মাছকে ‘হিলসা-ইলিশ’ নামের সঙ্গে জুড়ে দেন। ‘হিলিশা’ এবং ‘ইলিশ’কে করেন ‘ইলিশা’।
দ্বাদশ শতকে পণ্ডিত জীমূতবাহন এই মাছের নাম ‘ইলিশ’ বলে গেছেন। শুধু তা-ই নয়, একই শতকে সর্বানন্দের ‘টীকাসর্বস্ব’ গ্রন্থেও পরিষ্কারভাবে ‘ইল্লিশ’ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। ভারতচন্দ্রের লেখায় ‘পাঙ্গাশ ইলিশ’ বলে একটি শব্দ পাওয়া যায়।
ছোট ইলিশ মাছ বোঝাতে ভারতে ‘খয়রা’ কথাটি যেমন ব্যবহার করা হয়, তেমনি ‘খরগামী’ শব্দটি ইলিশজাতীয় ছোট মাছ বোঝাতেও ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে বলা হয় ‘জাটকা’। তবে জাটকা শব্দটির মূল জানা যায়নি। বাংলাদেশ ও ভারতের বেশির ভাগ অভিধানে ইলিশ শব্দটিকে ‘অর্বাচীন সংস্কৃত’ বলা হয়েছে।
দিগেন বর্মণ তাঁর ‘ইলিশ পুরাণ’-এ লিখেছেন ‘ইল’ মানে জলে নামা বা জলের মধ্যে আর ‘ঈশ’ মানে শাসক, কর্তা, প্রভু বা রাজা। ইল+ঈশ=ইলীশ। এই শব্দের মানে দাঁড়াল, ‘যে জলের রাজা সে-ই ইলিশ।’ আজকাল ‘ইলিশ’—এই বানানে লেখা হয়। কিন্তু ব্যুৎপত্তিসম্মত বানান হওয়া উচিত ‘ইলীশ’। তবে তিনি নিজেই তাঁর গবেষণাকর্মে ‘ইলিশ’ বানানই রেখেছেন।
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ ভারত আর পাকিস্তানেও জনপ্রিয়। তেলুগুতে এটা পিউলাসা বা পুলাসা, সিন্ধিতে পালু মাচ্চি, গুজরাটে মুডেন বা পেলভা নামে পরিচিত।
ইলিশের জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটে সাগরে। কিন্তু ডিম পাড়ার আগে এক হাজার ২০০ কিলোমিটার সাঁতরে ওরা নদীর মিঠা পানিতে আসে।
ইলিশ মাছের দৈর্ঘ্য ৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। তবে বাজারে সচরাচর যেসব ইলিশ চোখে পড়ে সেগুলোর দৈর্ঘ্য ৩৫ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার। ইলিশ মাছের জন্য সমুদ্র ও নদীর জল দুইয়েরই প্রয়োজন হয়। এ জন্য ইলিশ মাছকে উভজল মাছও বলা হয়।
গুজরাটি এক প্রবাদে রয়েছে, ‘ইলিশ মাছ খাও, দেশে থেকে যাও।’ তবে ইলিশ মাছ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আবেগ ও ভালোবাসা বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায়। বাংলাদেশে পান্তা-ইলিশ এখন শহুরে সংস্কৃতির একটি অংশ। আর পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের পূজায় চলে সরষে ইলিশ।
সর্বানন্দ তাঁর ‘টীকাসর্বস্ব’ গ্রন্থে ইলিশ মাছ এবং এর তেল বাঙালির প্রিয় বলে উল্লেখ করেছেন। ‘বিজয়গুপ্ত মনসামঙ্গল’ কাব্যে দক্ষিণ সাগর কলা দিয়ে ইলিশ মাছের অপূর্ব ঝোলের কথা বলা হয়েছে :
‘আনিয়া ইলিশ মৎস্য
করিল ফালা ফালা
তাহা দিয়া রান্ধে ব্যঞ্জন
দক্ষিণ সাগর কলা।’
ভারতচন্দ্র তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে ৩১টি মাছের নাম পর পর জুড়ে ১০ লাইনে স্বয়ংসম্পূর্ণ যে সুস্বাদু পদটি রচনা করেছিলেন তার সর্বশেষ নামটি ছিল ইলিশ।
হালে বাংলাদেশিরা ‘কূটনৈতিক মাছ’ ইলিশের চির-অভিনন্দিত স্বাদ চেখে দেখার সুযোগ চাইলেও সাধ আর সাধ্যে বেজায় ফারাক রয়ে গেছে। এই ফারাক কিভাবে ঘুচবে, তা-ও কেউ জানে না। এটা জানলে দিগেন বর্মণ তাঁর ‘ইলিশ পুরাণে’ কি লিখতে পারতেন : “স্বয়ং শাস্ত্রকাররাই ইলিশকে ‘নিরামিষ’ বলে সনদ দিয়েছেন!” বোঝা যাচ্ছে, জনগণের নাগালের বাইরে থাকলেও শাস্ত্রীয় সনদ পাওয়া ইলিশের দীর্ঘজীবী হতে আর বাধা নেই। অতএব, জয়তু ইলিশ! দম মারো দম!
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন