কোটা সংস্কার আন্দোলনে যেসব নারী শিক্ষার্থী সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের অন্যতম একজন উমামা ফাতেমা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী উমামা শেখ হাসিনা পতনের আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। আন্দোলনে যুক্ত হওয়া, নারীদের ভূমিকা, রাষ্ট্রীয় সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের সময়ের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশিকুল হক রিফাত।
আমাদের সময় : আন্দোলনে কীভাবে যুক্ত হয়েছেন?
উমামা ফাতেমা : ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সেই জায়গা থেকে পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আইডিয়া ছিল যে কী হতে পারে। ৫ জুন যখন কোটাব্যবস্থা পুনর্বহাল করা হয়, তখন আমাদের কাছে মনে হয়েছে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে অপমান করা হয়েছে। এই চিন্তা থেকে আন্দোলনটা শুরু করি। আমরা আন্দোলনের ফল জানতাম না। তবে ৫৬ শতাংশ কোটা না রাখার দৃঢ়তা আমাদের মধ্যে ছিল।
আমাদের সময় : সফলতার ব্যাপারে কতটুকু আশাবাদী ছিলেন?
উমামা ফাতেমা : আন্দোলনে ১ থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত শিক্ষার্থী সংখ্যা কিন্তু কমেনি। যখন ছাত্রদের সংখ্যা কমেছে, তখন ছাত্রীদের সংখ্যা বেড়েছে। ৫ জুলাই থেকে আস্তে আস্তে ছাত্রদের হলগুলোতে চাপ (ছাত্রলীগের বাধা) বেড়ে যায়। এতে আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ কমে যায়। ওই সময় আবার ছাত্রীদের হল থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী আসতে শুরু করে। প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেয়। ওই জনস্রোত দেখে আমরা বুঝে গিয়েছিলাম আন্দোলনে সফলতা আসবে। এদিকে সরকার আন্দোলনটাকে গুরুত্ব না দেওয়ায় এটা দীর্ঘায়িত হচ্ছিল। এ নিয়ে একটা আশঙ্কাও তৈরি হয়েছিল। সফলতার ব্যাপারে আমরা আশাবাদের পাশাপাশি আশঙ্কাগ্রস্তও ছিলাম।
আমাদের সময় : গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী আপনাদের চাওয়া-পাওয়া কী?
উমামা ফাতেমা : আমাদের গণ-অভ্যুত্থানের একটা কমন মেসেজ ছিল, গত ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনা যে ফ্যাসিবাদী সিস্টেম চালিয়েছে, সেই সিস্টেমে আমরা ফেরত যেতে চাই না। আমরা রাষ্ট্র সংস্কার করে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। আমরা মনে করি, সব রাজনৈতিক দল মিলে একসঙ্গে রাষ্ট্র সংস্কার এগিয়ে নিতে হবে।
আমাদের সময় : পুরো আন্দোলনে নারীদের কেমন ভূমিকা ছিল?
উমামা ফাতেমা : আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। একজন নারীর কিন্তু পুরুষের মতো শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা থাকে না। ১ জুলাই থেকে নারীরা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে আন্দোলন করে গেছে। পুরুষের তুলনায় নারীকে অনেক বেশি সামাজিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে মিছিলে আসতে হয়। যখন নারীরা এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা পার করে, তখন আন্দোলন জমে ওঠে। ১৫ জুলাই যখন দুই-তিন হাজার মেয়ে হামলার শিকার হয়, তখন দেশব্যাপী আন্দোলনের পক্ষে জাগরণ সৃষ্টি হয়। এরপর সারাদেশে নারীরা রাস্তায় নেমে আসে। এতে সরকারের পক্ষে আন্দোলন দমন করাটা কঠিন হয়ে পড়ে।
আমাদের সময় : সুযোগ এলে নারীদের জন্য কী কী করতে চান?
উমামা ফাতেমা : নারী যেন কোনো প্রকার ভয় ছাড়া দিনে বা রাতে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারে, সেই ধরনের সমাজব্যবস্থা তৈরি করতে চাই। সব প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নের বিচার হওয়া, কর্মক্ষেত্রে নারীরা যাতে অধিকার বঞ্চিত না হয়, সেই ব্যবস্থা চাই। পাশাপাশি চাকরিজীবী নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করা এবং প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপনের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে।
আমাদের সময় : আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের কথা বলেছেন, এ ব্যাপারে কতটুকু এগিয়েছেন?
উমামা ফাতেমা : রাষ্ট্রীয় সংস্কারের জন্য ইতোমধ্যে জাতীয় নাগরিক কমিটি করা হয়েছে। নাগরিক কমিটি ভাবছে, কীভাবে সংস্কারের প্রস্তাবনা সরকারকে দিতে পারে। সারাদেশে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে, সেগুলো থামিয়ে একটা কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা। এটাই বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মের লক্ষ্য। রাষ্ট্র সংস্কার করতে হলে সরকারকে আগে নির্বাচন কমিশন ও সংবিধান সংস্কার করতে হবে। তা না হলে রাষ্ট্র সংস্কার সম্ভব হবে না।
আমাদের সময় : গুঞ্জন রয়েছে আপনারা রাজনৈতিক দল গঠন করবেন?
উমামা ফাতেমা : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দল করবে কিনাÑ এ নিয়ে আমাদের মধ্যে মত, ভিন্নমত আছে। পরিস্থিতি অনেক কিছুর উত্তর দিয়ে দেবে।
আমাদের সময় : বাংলাদেশে ‘ল অ্যান্ড অর্ডার’ এখনো পুরোপুরি ফেরেনি। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
উমামা ফাতেমা : সরকারের পক্ষ থেকে তেমন জোর তৎপরতা দেখছি না। যার প্রভাব স্থানীয় পর্যায়ে পড়ছে। প্রশাসন এখনও সক্রিয় হচ্ছে না। বন্যার সময়ও প্রশাসন খুব একটা সক্রিয় ছিল না। শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। বিষয়টি এমনÑ একটা দেশের আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব কিন্তু শিক্ষার্থীরা নিতে পারে না। সরকার যত দিন পর্যন্ত সক্রিয় না হচ্ছে, এই ব্যবস্থাটা ঠিক তত দিন থাকবে। শিক্ষার্থীদের একটা সময় ক্লাসে ফেরা লাগবে। ইতোমধ্যে ক্লাসে ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে আমাদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার সুযোগ সরকারকেই করে দিতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন