বিদেশে চাকরি করা অবস্থায় ২০১৭ সালে গ্রামের বাড়িতে একটি গরুর খামার করেন ফিজার আহমেদ। ধীরে ধীরে সেখানে ছাগল ও হাঁস পালনের পাশাপাশি জমিতে সবজি ও পুকুরে মাছ চাষ শুরু করেন। এরপর বিদেশের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দেশে এসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যুক্ত হন। পাশাপাশি গ্রামের বাড়িতে তৈরি করা সমন্বিত খামারে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করেন।
ফিজার আহমেদের এই সমন্বিত কৃষি খামারের অবস্থান নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার তালঝারী গ্রামে। যেখানে বৈচিত্র্যময় কৃষিপণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় আধুনিক খামার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। কার্বন নিঃসরণ রোধ, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পরিবেশবান্ধব কেঁচো সার উৎপাদন করে কৃষিতে নতুন সম্ভাবনার পথ দেখাচ্ছেন তিনি। কেঁচো সার উৎপাদনের কলাকৌশল শিখিয়ে তা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করছেন অন্য কৃষি উদ্যোক্তাদেরও। আর্থিক লাভের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব কৃষি সম্প্রসারণে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে ফিজার আহমেদের ‘তালঝারী কৃষি খামার’।
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি (রুয়েট) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল (ইইই) বিভাগ থেকে স্নাতক পাস করার পর ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার্স করেন ফিজার আহমেদ। এরপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্কলারশিপ পেয়ে হাঙ্গেরির করভেনাস ইউনিভার্সিটি অব বুদাপেস্ট থেকে বিজনেস ইনফরমেটিকস বিষয়ের ওপর পিএইচডি করেন তিনি। এরপর জার্মানিতে কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইনোটেক-২১ কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে চলে যান। কোম্পানিটি আফ্রিকার সাব-সাহারান দেশগুলোয় কৃষিতে আইওটির (ইন্টারনেট অব থিংস) ব্যবহার নিয়ে কাজ করছিল। ওই প্রতিষ্ঠানে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কাজ করেন ফিজার আহমেদ। বর্তমানে তিনি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
তালঝারী কৃষি খামারে একদিন
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, আলাদা আলাদা শেডে গরু, ছাগল ও হাঁস রাখা হয়েছে। সেগুলো দেখাশোনা করছেন শ্রমিকেরা। কয়েকজন ভার্মি কম্পোস্ট শেড থেকে কেঁচো সার তুলে বায়োগ্যাস জেনারেটরের সাহায্যে নেটিং মেশিনে চালুনি দিচ্ছেন। এতে কেঁচো সার আরও ঝকঝকে ও নিখুঁত হচ্ছে। সবকিছু তদারক করছেন ফিজার আহমেদ।
আলাপকালে ফিজার আহমেদ বলেন, প্রতিটি ব্যবসায় মাসিক হিসাব রাখা যায়। কিন্তু খামারের লাভ-লোকসান প্রতি মাসে বোঝা যায় না। কোরবানির আগে খামারে ৮০-৯০টি গরু ছিল। কোরবানির সময় বিক্রির পর এখন আছে ১৬টি। ছাগল ছিল ১০০টি ওপরে, কোরবানির সময় বিক্রির পর এখন রয়েছে ৪০টির মতো। হাঁস আছে ৮০০টি। ১২ জন কর্মচারী ও ১ জন ব্যবস্থাপকের বেতন বাদে লালন-পালন করা গবাদিপশু ও পুকুরের মাছ বিক্রি করে বছরে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা আয় আসে। এ ছাড়া কেঁচো সার বিক্রি করে আরও ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা আয় হয়। খামারে উৎপাদিত কেঁচো সার অফলাইনের পাশাপাশি অনলাইনে বাজারজাত করা হয়ে থাকে।
আফ্রিকার অভিজ্ঞতায় খামারের চিন্তা
জার্মান প্রতিষ্ঠান ইনোটেক-২১-এ চাকরির সময় ফিজার আহমেদের দায়িত্ব ছিল আফ্রিকার দেশগুলোয় কৃষিপ্রযুক্তিতে আইওটি বা ইন্টারনেট অব থিংস (বিভিন্ন জিনিসপত্রের সঙ্গে ইন্টারনেটের সংযোগ) ব্যবহার নিশ্চিত করা। ফিজার বলেন, ‘কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, আফ্রিকার সাব-সাহারান দেশের নিষ্ফলা মাটিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে ফসল উৎপাদন বাড়িয়ে কীভাবে খাদ্যসংকট মোকাবিলা করা হচ্ছে। তখন আমার মনে হয়েছে, আফ্রিকার নিষ্ফলা মাটিতে যদি আইওটি যন্ত্রাংশের ব্যবহার করে সুফল পাওয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশের সোনার মাটিতে আইওটির ব্যবহারে আরও সুফল পাওয়া যাবে। সেই চিন্তা থেকে দেশে একটা আধুনিক খামার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব খামার তৈরির স্বপ্ন দেখা।’
ফিজার এই খামারের স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) অধীনে অর্থসহায়তা পেয়েছেন। এ ছাড়া টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) হাউসহোল্ড এনার্জি প্রোডাকশন (হেপ) প্রকল্পের অধীনে অর্থসহায়তা করেছে।
ফিজার জানান, ২০১৭ সালে গ্রামের বাড়িতে নিজের ছয় বিঘা জমিতে দুটি শেড তৈরি করে প্রথমে কিছু গরু ও ছাগল কিনে লালন-পালন শুরু করেন। এ কাজে পরিবারের লোকজন ও বন্ধুরা খুব সাহায্য করেছেন। খামারের গরু ও ছাগল থেকে পাওয়া গোবর ও মূত্র থেকে প্রচলিত পদ্ধতিতে স্বল্প পরিসরে কেঁচো সার উৎপাদন করা হতো। এরপর ২০১৯ সালে দেশে আসার পর খামারসংলগ্ন আরও ছয় বিঘা জমি ইজারা নিয়ে সেটাতে পুকুর খনন করে মাছ ও হাঁস পালন শুরু করেন। পাশাপাশি সম্পূর্ণ যান্ত্রিক পদ্ধতিতে বায়োগ্যাস উৎপাদন করে বিদ্যুৎ ও কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করেন। যান্ত্রিক কলাকৌশল ব্যবহার করায় প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে নির্দিষ্ট সময়ে দ্বিগুণ সার উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। এখন তিনি খামারে গবাদিপশু লালন-পালন করে যে আয় করেন, খামারের বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কেঁচো সার উৎপাদন করে সে পরিমাণ আয় করছেন।
নেটিং মেশিনে চালুনি দিয়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে কেঁচো সার। সম্প্রতি নওগাঁর তালঝারী কৃষি খামারেছবি: প্রথম আলো
দৈনিক ৫ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ, এক টন সার উৎপাদন
খামার ঘুরে দেখা গেল, ফিজারের ভার্মি কম্পোস্ট শেডে ২০০টি চেম্বার রয়েছে। প্রতিটি চেম্বার থেকে মাসে ১২০-১৩০ কেজি সার পান তিনি। এ ছাড়া খামারে সম্প্রতি স্থাপন করা হয়েছে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ শেড। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ওই শেডে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে সারা বছর কেঁচো উৎপাদন করা হয়।
বায়োগ্যাস প্ল্যান্টে পাওয়া তরল বর্জ্য (বায়োস্লারি) মেশিনের সাহায্যে পানি ছাড়িয়ে শুষ্ক বর্জ্য (সলিড) নেওয়া হয় ভার্মি কম্পোস্ট শেডে। যেখানে তৈরি হচ্ছে ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার। আর মিশ্রিত পানি নালা দিয়ে চলে যায় সবজি ও ধানখেতে। প্রতিদিন গড়ে এক টন করে কেঁচো সার পান তিনি। প্রতি কেজি কেঁচো সার বিক্রি করেন ১৫ টাকা কেজি। মাসে দেড় লাখ টাকার অধিক কেঁচো সার বিক্রি করেন তিনি। এ ছাড়া গবাদিপশু লালন-পালন করে মাসে আরও আড়াই লাখ টাকা আয় হয়। খরচ বাদ দিয়ে বর্তমানে মাসে গড়ে ২ লাখ টাকা আয় করছেন তিনি।
খামারের ব্যবস্থাপক রাশেদুল ইসলাম জানান, ভার্মি কম্পোস্টের প্রতিটি চেম্বারে ৩৫ থেকে ৪০ কেজি শুষ্ক বর্জ্যের সঙ্গে ৯-১০ হাজার কেঁচো ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে সার পাওয়া যায়। সেগুলো সংগ্রহ করে জেনারেটরের সাহায্যে নেটিং মেশিনে চালুনি দিয়ে নিখুঁত ও ঝকঝকে করা হয়। এ ছাড়া সারের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য রয়েছে রিমোট মনিটরিং সিস্টেম। যেখানে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়ামসহ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা পর্যবেক্ষণ করা হয়।
উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন ফিজার
প্রচলিত ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে মাটির সোনা বা ব্রাউন গোল্ড হিসেবে পরিচিত কেঁচো সার তৈরি হয়ে আসছে। কিন্তু যান্ত্রিক কলাকৌশল ও আইওটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাণিজ্যিকভাবে কেঁচো সার উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফিজার আহমেদ উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তালঝারী কৃষি খামারে যান্ত্রিক কলাকৌশল ও আইওটি প্রযুক্তির ব্যবহার করে যে পদ্ধতিতে কেঁচো সার উৎপাদন করা হচ্ছে, তা সারা দেশের মধ্যে অনন্য। কৃষি বিভাগ তাঁকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে আসছে।
দুই বছর ধরে তালঝারী কৃষি খামারে উৎপাদিত কেঁচো সার ব্যবহার করছেন নাটোরের কৃষি উদ্যোক্তা আরিফ ড্রাগনপল্লির মালিক তারেক রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এর আগেও অন্য উদ্যোক্তার কাছ থেকে কেঁচো সার আমার বাগানে ব্যবহার করেছি। সেই সারের তুলনায় তালঝারী কৃষি খামারের সারের গুণ অনেক ভালো। সারের গুণাগুণ ঠিক আছে কি না খামারে গিয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার করে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে পরীক্ষা করা যায়। এই সার ব্যবহারের পর আমার বাগানের গাছ ভালো পুষ্টি পাচ্ছে এবং ফলনও আগের চেয়ে বেড়েছে।’
ফিজার আহমেদকে দেখে অনেকেই পরিবেশবান্ধব কৃষি খামারে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। তাঁদের একজন যশোরের কৃষি উদ্যোক্তা জাহিদুল ইসলাম। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এক বছর আগে বগুড়ায় একটি প্রশিক্ষণে ফিজার আহমেদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পরে তালঝারী কৃষি খামার ঘুরে দেখেন। ছয় মাস আগে যশোর সদর উপজেলায় বিমানবন্দরসংলগ্ন একটি স্থানে তিনি গরু-ছাগল পালনের পাশাপাশি কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করেন। ভবিষ্যতে তালঝারী কৃষি খামারের মতো যান্ত্রিক উপায়ে বায়োগ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কেঁচো সার উৎপাদন করতে চান।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন