ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময়ে পুলিশের ওপরে হামলা, থানা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ভীতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে তেজগাঁও শিলাঞ্চল থানা পুলিশ। তারা বলছেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশের ওপর তৈরি হওয়া ক্ষোভ ও অসন্তোষ দূর করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি পুলিশ সদস্যদের বিভিন্নভাবে কাউন্সেলিং এবং থানা এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্যান্য থানার মতো তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর প্রায় এক সপ্তাহ বন্ধ থাকে থানার কার্যক্রম। পরে ১১ আগস্ট শুরু হয় থানার কার্যক্রম। নতুনভাবে থানা চালাতে কনস্টেবল থেকে শুরু করে পরিদর্শক (ওসি) পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যদেরকে বদলি করা হচ্ছে। জনবল সংকটের পাশাপাশি যানবাহন ও অন্যান্য সরঞ্জামের ঘাটতিও রয়েছে এ থানায়। ফলে সেবা ও বিটভিত্তিক টহল কার্যক্রমে কিছুটা সংকটও দেখা দিয়েছে পুলিশের।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা এলাকায় বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেশ কয়েকটি ঘনবসতি এলাকা রয়েছে। ফলে প্রায় প্রতিদিনই চুরি-ছিনতাই, মারামারিসহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে থানায় আসছেন অনেক সেবাপ্রত্যাশী।
থানা সূত্রে জানা যায়, ১৮ সেপ্টেম্বর (বুধবার) পর্যন্ত এ থানায় ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও হত্যার অভিযোগে তিনটি মামলা হয়েছে। এছাড়াও হত্যা, মারামারি ও মাদক সংশ্লিষ্ট আরও ১৮টি মামলা হয়েছে। এসময়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক সমস্যা, হুমকি ও বিভিন্ন কিছু হারানোর অভিযোগে এক হাজার ৯৮০টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) জমা পড়েছে এ থানায়।
পুলিশ সদস্যরা বলছেন, এখনও রাস্তায় তাদের দেখলে মানুষ নানান রকমের কথা বলে। নানান বিরূপ মন্তব্য শুনতে হচ্ছে তাদের। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ধৈর্য্য ধরছে পুলিশ সদস্যরা। এর মধ্যেই আসামি ধরতে যেতে হচ্ছে একাধিক পুলিশ সদস্যকে। জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের নিরাপত্তাও এখন বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন তারা।
থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মুরশিদুল আলম বলেছেন, ‘কিছু মানুষ এখনও পুলিশের ওপর বীতশ্রদ্ধ মনে হচ্ছে। তারা সুযোগ পেলেই পুলিশের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে। গত সপ্তাহে মহাখালী বাসটার্মিনাল এলাকার একটি ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে একজন ট্রাফিক কনস্টেবল দায়িত্ব পালনের সময় মোটরবাইকের চালককে দাঁড়ানোর সিগন্যাল দিলে চালক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে খুবই খারাপ আচরণ করেন। তার পরিবার তুলে প্রচণ্ড বকাবাদ্য করেন। এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে পুলিশের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়বে।’
এসআই মুরশিদুল আলম আরও বলেন, আমরা চেষ্টা করছি জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে পুলিশের প্রতি তাদের বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের চেষ্টা করা হচ্ছে।
থানা ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। এদিন বিকাল চারটার দিকে একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতা থানায় হামলা চালায়। থানার কয়েকটি গাড়ি ও ওসির কক্ষে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের ওপর হামলা চালানো হয়। এতে প্রাণভয়ে থানার পেছন দিয়ে পালিয়ে যান পুলিশ সদস্যরা। এসময় থানা থেকে চায়না ও তরাশ পিস্তল ১০টি, রাবার ও সিসা কার্তুজ গুলি ৪৯টি এবং চায়না ও তরাশ পিস্তলের ১৯৩ রাউন্ড গুলি ও ২৪টি ম্যাগজিন লুট হয়। এছাড়াও থানার ভেতর থেকে ওয়্যারলেস সেট, সিসি ক্যামেরা, কম্পিউটার, সিলিং ফ্যানসহ চারতলা থানা ভবনের বেশিরভাগ মালামাল চুরি ও লুটপাট করা হয়েছে। এখন পরিস্থিতি উন্নয়নের চেষ্টা করছে থানার পুলিশ সদস্যরা। তারা নিজ উদ্যোগে থানার ভবন মেরামত ও সংস্কারের চেষ্টা করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থানার একজন উপ-পরিদর্শক জানান, পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এখনও নানাভাবে ভয়-ভীতি কাজ করছে। ৫ আগস্ট বিভিন্ন থানা থেকে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাট হয়েছে। যার বেশিরভাগ এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ফলে যেকোনও সময় আবারও পুলিশের ওপর হামলা হবে না, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না। এছাড়াও মাদক ও চুরি-ছিনতাই বেড়েছে কয়েকগুণ। তাদের গ্রেফতারেও বিভিন্নভাবে বেগ পোহাতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতেও সাধারণ মানুষের বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গাজী শামিমুর রহমান বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট থানায় অগ্নিকাণ্ড, হামলা ও লুটপাটে অনেক লজিস্টিক সাপোর্ট এবং ইকুইপমেন্ট খোয়া গেছে। পর্যায়ক্রমে ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনা মেরামত করা হচ্ছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পুলিশ সদর দফতর থেকে রিকুইজিশন দিয়ে বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট আনা হচ্ছে।
ওসি আরও বলেন, ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু— এটা কথায় নয়, সত্যিকারের জনগণের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করছি। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে পুলিশের মনোবল চাঙ্গা করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময় পুলিশ সদস্যদের কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। পুলিশের সঙ্গে জনগণের সুসম্পর্ক গড়তে বিভিন্ন কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। এছাড়াও জনসাধারণের মধ্যে পুলিশের প্রতি ক্ষোভ দূর করার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রতিটি করপোরেট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মতবিনিময় করা হচ্ছে। তাদের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে। মসজিদ ও এলাকাভিত্তিক সভার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেকটা ভালো হয়েছে বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন