২০০২ সালের পর এবারই প্রথম বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে জননিরাপত্তায় মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী। সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থা ফেরাতে আইনশৃঙ্খলা বিঘœকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হচ্ছে তারা। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাবলে অপরাধীদের গ্রেপ্তার, শাস্তি ও জামিন দিতে পারবেন সেনা কর্মকর্তারা। ফলে ভয় ও আতঙ্কে অপরাধীরা আইন ভঙ্গ না করার প্রতি সচেতন থাকবে; ধারাবাহিক অভিযানে ধরা পড়বে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও অস্ত্রধারীরা। এ ছাড়া তৈরি পোশাকশিল্পসহ সব ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। ফলে জনগণের মধ্যে ভীতি কেটে যাবে, ফিরবে আস্থা। এমনটাই মনে করছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নীতিনির্ধারকসহ নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলেও মাঠপর্যায়ে এখনও শৃঙ্খলা ফেরেনি। পুলিশ অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। ফলে তৈরি পোশাক খাতসহ বিভিন্ন খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। গণপিটুনিতে হত্যাসহ ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। বিচারিক ক্ষমতা পাওয়ার পর এখন কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে সেনাবাহিনীকে প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। সেনাবাহিনীর হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকলে শিগগিরই মাঠের পরিস্থিতি বদলে যাবে, কেটে যাবে সংকট।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতা ও ভয়ভীতি কাজ করছে। সেনাবাহিনী বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে মাঠে নামায় সেটা থেকে পরিত্রাণ মিলবে। কাউকে গ্রেপ্তার, দ- প্রদান কিংবা জামিন দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনী এখন কারও মুখাপেক্ষী থাকবে না। কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে সেনাবাহিনীকে প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। মানুষ যখন দেখবে, অপরাধীর বিরুদ্ধে দ্রুত অ্যাকশন হচ্ছে তখন ভীতি কেটে আস্থা ফিরবে। আর অপরাধী বুঝবে, ধরলে এখন আর সহজে পার পাব না। ফলে তারা ভয়ে অপরাধ থেকে দূরে থাকবে।
ওয়ান ইলেভেনে সেনাবাহিনীর এই বিচারিক ক্ষমতা ছিল কিনা, জানতে চাইলে এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, তখন ছিল ইন এইড টু দ্য সিভিল পাওয়ার (বেসামরিক ক্ষমতাকে সামরিক সহায়তা)। অর্থাৎ একজন ডিসি কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট রিকুইজিশন দেন যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত শক্তি নেই, আমাদের সহায়তা করুন। এখন প্রত্যেক সেনা কর্মকর্তাকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়ায় অভিযানে যেতে, গ্রেপ্তার করতে ও দ- দিতে অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ঢাকাসহ সারাদেশে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে গত ১৯ জুলাই রাতে দেশজুড়ে কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েন করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। বাংলাদেশে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালন করেছে। বিভিন্ন কাজে মাঠ প্রশাসনকে সহায়তাও করেছে সেনাবাহিনী। সাধারণত দেশে জরুরি অবস্থার পরিস্থিতি ছাড়া সেনাবাহিনীর হাতে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হয় না। তবে সর্বশেষ ২০০২ সালে অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে বিশেষ অভিযান চালাতে মাঠে নামানো হয়েছিল সেনাবাহিনীকে। এরপর ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনের সময় দায়িত্ব পালন করেছিল ফখরুদ্দিন আহমেদের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেই সময় দেশে জরুরি অবস্থা জারি ছিল। ফলে আলাদা ঘোষণা দিয়ে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিতে হয়নি। তবে সেনাসদস্যরা আটক বা গ্রেপ্তার, অভিযান বা তল্লাশির মতো কাজগুলো করেছেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, সেনাবাহিনীকে যে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, এর সুফল ভোগ করবে বাংলার জনগণ। সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে মাঠে আছে। তাই তাদের একটা ক্ষমতার ভেতরে কাজ করতে হবে। আমাদের অন্যান্য বাহিনীরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, এটা পূরণ করার জন্য সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দরকার।
বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পাওয়া সেনা কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তারা অপরাধীকে গ্রেপ্তার, শাস্তি ও জামিন দিতে পারবেন। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা আগামী দুই মাস ফৌজদারি অপরাধের বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের
ক্ষমতা দিয়ে মঙ্গলবার যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭টি ধারায় সেনা কর্মকর্তারা তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর ৬৪, ৬৫, ৮৩, ৮৪, ৯৫ (২), ১০০, ১০৫, ১০৭, ১০৯, ১১০, ১২৬, ১২৭, ১২৮, ১৩০, ১৩৩ ও ১৪২ ধারা অনুযায়ী সেনাবাহিনীকে এ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ধারায় গ্রেপ্তার ও গ্রেপ্তারের আদেশ, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করা, তল্লাশি পরোয়ানা জারি, অসদাচরণ ও ছোটখাটো অপরাধের জন্য মুচলেকা আদায়, মুচলেকা থেকে অব্যাহতি, বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ, স্থাবর সম্পত্তি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বাধা অপসারণ এবং জনগণের ক্ষতির আশঙ্কা করলে সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ বিভিন্ন ক্ষমতা পাবেন বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।
ফৌজদারি কার্যবিধির এসব ধারা অনুযায়ী, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পাওয়ায় এখন থেকে সেনা কর্মকর্তাদের সামনে কোনো অপরাধ হলে অপরাধীদের সরাসরি গ্রেপ্তার করতে পারবেন, দিতে পারবেন জামিনও। বাংলাদেশের যে কোনো স্থানে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করতে পারবেন সেনা কর্মকর্তারা। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করতে পুলিশকে নির্দেশও দিতে পারবেন তারা। বেআইনিভাবে আটক ব্যক্তিকে উদ্ধারের জন্য তল্লাশি করতে পারবেন।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এখন থেকে সেনা কর্মকর্তারা বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে পারবেন। একই সঙ্গে এটি বন্ধে বেসামরিক বাহিনীকেও ব্যবহার করতে পারবে সেনাবাহিনী। এ ছাড়াও স্থানীয় উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন আদেশ জারি করতে পারবে, আটক করতে পারবে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকেও।
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, দেশে বর্তমানে কিছু কিছু এলাকায়, বিশেষ করে শিল্পাঞ্চলগুলোয় নাশকতা ও দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের মতো কর্মকা- ঘটছে বলে সরকার লক্ষ্য করছে। উদ্ভূত পরিস্থিতির উন্নতি এবং অপতৎপরতা মোকাবিলার জন্য সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সীমিত সময়ের জন্য এ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে সেনাবাহিনীর এমন দায়িত্ব পালনের প্রয়োজনীয়তা আর থাকবে না।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ জাতীয় নির্বাচনেই সেনাবাহিনী মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সময় নির্বাচনের দায়িত্ব পালনকালে সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিতে ইসির কাছে দাবিও জানিয়েছে। কিন্তু অতীতের কোনো নির্বাচন কমিশনই সেনাবাহিনীকে সেই ক্ষমতা দেয়নি।
ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের সাবেক প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ও ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ এহসানুল হক সমাজী বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সিআরপিসির বিধান অনুযায়ী সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এখন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন।
সিআরপিসির ৬৪ ধারায় বলা হয়েছে, যখন ম্যাজিস্ট্রেট দেখতে পান তার সামনে কোনো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, তখন তিনি অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে পারেন অথবা গ্রেপ্তারের আদেশ দিতে পারেন।
সিআরপিসির ৬৫ ধারায় বলা হয়েছে, বিচারের জন্য গ্রহণ করার পর তিনি তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারেন। অথবা তাকে তিনি গ্রেপ্তারের হুকুম দিতে পারেন।
সিআরপিসির ১০৭ ধারা অনুযায়ী, যখন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা অন্য কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে জানানো হয় যে কোনো ব্যক্তি শান্তি ভঙ্গ করতে পারেন বা সর্বসাধারণের প্রশান্তি বিনষ্ট করতে পারেন বা এমন কোনো কাজ করতে পারেন, যাতে শান্তি ভঙ্গ হতে পারে, তখন ম্যাজিস্ট্রেট যদি মনে করেন, তা হলে ওই ব্যক্তিকে শান্তি রক্ষার জন্য এক বছরের অনধিক সময়ের মুচলেকা দেওয়ার জন্য কারণ দর্শাতে বলতে পারেন।
সিআরপিসির ১২৭ ধারায় বলা হয়েছে, এ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেট অথবা পুলিশের আদেশে জনসমাবেশ ছত্রভঙ্গসংক্রান্ত বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অথবা কোনো থানার ওসি কোনো বেআইনি সমাবেশ অথবা সর্বসাধারণের শান্তি বিনষ্ট হওয়ার কারণ ঘটাতে পারে এমন পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে কোনো সমাবেশ ছত্রভঙ্গ হওয়ার আদেশ দিতে পারেন।
জনপ্রশাসন সচিব মোখলেস উর রহমান জানিয়েছেন, দেশে একটি জনবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সাধারণ প্রশাসন ক্যাডারদের সঙ্গে সেনাবাহিনীকে দেওয়া ক্ষমতার সাংঘর্ষিক বিষয় আছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা কোনো ক্যাডারের ক্ষমতা না, এটা রাষ্ট্রের ক্ষমতা। সাংঘর্ষিক কিছু হবে না। সবাই মিলে এক রাষ্ট্র, সরকার, জনগণ। জনস্বার্থে আপনি কাজ করেন, আমি কাজ করি। সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করলে ভালো ফল আসবে।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যাতে দ্রুত ঠিক হয়ে যায়, জননিরাপত্তা যাতে নিশ্চিত হয়, আমরা যেহেতু একটি জরুরি পরিস্থিতিতে ি, দেশ পুনর্গঠন করা লাগছে, সেহেতু সেনাবাহিনীকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন