উদ্ভাবনের ৯ বছর পর আলোর মুখ দেখার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে ‘পরিবেশবান্ধব’ পাটের সোনালি ব্যাগের। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন বৈঠকে এটি বাস্তবায়নে জোর দেওয়া হয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও ‘পরিবেশবান্ধব পাটের ব্যাগ’ ব্যবহারের বিষয়ে কথা বলেন এবং ১ অক্টোবর থেকে তা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেন। এ ছাড়াও একাধিক অনুষ্ঠানে পাট ও বস্ত্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) ড. এম সাখাওয়াত হোসেনও পাটের ব্যাগ ব্যবহারের কথা বলেন। বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও পরিবেশ রক্ষায় পলিথিন নিষিদ্ধ এবং শপিংমলসহ সর্বত্র পাটের ব্যাগ ব্যবহারে জোর দেন। এরই অংশ হিসেবে আগামী ১ অক্টোবর থেকে যেন এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা যায়, সে লক্ষ্যে আজ বুধবার বিভিন্ন শপিংমলের কর্ণধারসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করবে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, পলিথিন নিষিদ্ধকরণে ২০০২ সালে একটি আইন হয়। বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নিলেও পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। পরিবেশবাদীরা বারবার এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও অজ্ঞাত কারণে আলোর মুখ দেখেনি পলিথিন নিষিদ্ধ আইন।
এদিকে নানা শঙ্কার মধ্যেও ২০১৫ সালে পাটের পলিথিন ব্যাগ অর্থাৎ সোনালি ব্যাগ উদ্ভাবন করে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ড. মোবারক আহমেদ খান। এর স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৪ সালে তাকে স্বাধীনতা পদকও দেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সোনালি ব্যাগ বাজারজাত করতে ২০১৮ সালে একটি পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ৭ এপ্রিল বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় এই ব্যাগ উৎপাদনের জন্য। পরবর্তী সময়ও প্রকল্প নেওয়া হয়। আরেকটি প্রকল্প প্রস্তাবিত পর্যায়ে আছে। তবুও সোনালি ব্যাগ যুগে প্রবেশ করেনি বাংলাদেশ। তবে সীমিত পরিমাণে উৎপাদন হওয়া সোনালি ব্যাগ মতিঝিলে বিজেএমসির কার্যালয় থেকে কেনা যায়। এই উদ্ভাবনের বিষয়টি বহির্বিশ্বে জানান দিতে বিভিন্ন দূতাবাসে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে ‘আলোড়ন সৃষ্টিকারী’ পচনশীল পাটের সোনালি ব্যাগ পলিথিনের বিকল্প হিসেবে সৃষ্টির পরিকল্পনা হলেও পলিথিনের দাপট কেন থামানো যাচ্ছে না, এমন প্রশ্ন অনেকের। একজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, পাট থেকে উৎপন্ন এই ব্যাগকে পলিথিনের বিকল্প বলা হচ্ছে প্রায় ৯ বছর ধরে। কিন্তু বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারছে না সরকার। সময়মতো এই প্রযুক্তি বাজারে এলে বাংলাদেশের চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে পারত। কিন্তু বিগত সময়ে মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বশীলরাই এটির অগ্রযাত্রায় বাধাগ্রস্ত করেছে। সাবেক পাটমন্ত্রী নিজেই সোনালি ব্যাগের ব্যবসা নিয়ে ভাবছিলেন, যে কারণে কাজটি শেষ সময়ে এসে আটকে যায়।
সাবেক মন্ত্রীর কারণে সোনালি ব্যাগের বিষয়টির যাত্রাপথ বাধাগ্রস্ত করেছে কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে এই মুহূর্তে দেশের বাইরে থাকা বিজ্ঞানী ড. মোবারক হোসেন হোটাসঅ্যাপে আমাদের সময়কে বলেন, বিষয়টি নিয়ে এ মুহূর্তে কথা বলতে চাচ্ছি না। তার সঙ্গে আমি কাজ করেছি তো। তারাও আগ্রহ দেখিয়েছেন। বর্তমান সরকারও বিষয়টিতে খুব আগ্রহী।
পাটের ব্যাগের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এই বিজ্ঞানী জানান, সোনালি ব্যাগ পচনশীল। দ্রুতই পচে যাবে। এমনকি মানুষের পেটে গেলেও তার ক্ষতি হবে না। পলিথিনের মতো কোথাও গিয়ে জমাট বাঁধবে না, পরিবেশন দূষণ হবে না। ফলে পরিবেশবান্ধব হওয়ার পাশাপাশি পচন সৃষ্টিতে কোনো প্রজেক্ট নেওয়ারও দরকার হবে না। সোনালি ব্যাগের দাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন প্রতি কেজি এক হাজার টাকায় বিক্রি হয়। প্রয়োজনে আরও কমতে পারে। ব্রেক ইভেন্ট হলে প্রতি পিস সর্বনিম্ন ৬টা পর্যন্ত বিক্রি করা যেতে পারে।
পাটের ব্যাগ ব্যবহার ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর হওয়ার বিষয়ে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুর রউফ আমাদের সময়কে জানান, পাটের ব্যাগ ব্যবহারে একাধিক বৈঠক হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদেও এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আজ সব শপিংমলের কর্ণধারসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক হবে। শপিংমলগুলোতে যাতে পলিথিনের পরিবর্তে পাটের ব্যাগের ব্যবহার নিশ্চিত হয় এ বিষয়ে পাট, বস্ত্র এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় যৌথভাবে তদারকি করবে। শপিংমলসহ সর্বত্র পণ্য কেনার পাশাপাশি পাটের ব্যাগ সংগ্রহ করতে হবে। বিভিন্ন দামের ব্যাগ থাকবে। একই ব্যাগ দিয়ে পুনরায় বাজার করতে পারবে।
ব্যাগ কারা উৎপাদন করবে, কারা বাজারজাত করবে, দাম নির্ধারণ কীভাবে হবে- এ সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে এবং দাম নির্ধারণে আজ বুধবার বৈঠকে সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানা গেছে। তবে অন্য সবের তুলনায় বাজারে পাটের সোনালি ব্যাগের চাহিদাই বেশি হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন