দরপত্র পাওয়ার প্রধান শর্ত যোগ্যতা। সে কাজ বাস্তবায়নে অনুসরণ করার কথা সরকারি ক্রয়বিধি (পিপিপি)। কিন্তু গত ১৫ বছরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে (চসিক) মেয়রের দায়িত্ব পালন করা তিন মেয়রের কেউই মানেননি কোনো নিয়ম। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে তিনজনই গুরুত্ব দিয়েছেন তাদের পছন্দের ঠিকাদারকে। দলীয় ঠিকাদারদের মাঝেই ভাগাভাগি করে দিয়েছেন প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার কাজ। এতে কমে গেছে প্রতিযোগিতা। খারাপ হয়েছে কাজের মানও। বেশির ভাগ প্রকল্পই শেষ হয়নি নির্ধারিত সময়ে। উল্টো বেড়েছে ব্যয়, গচ্চা গেছে হাজার হাজার কোটি টাকা। তার পরও একটু বৃষ্টি হলেই কোমরসমান পানিতে ডুবে যায় বন্দরনগরী। নাগরিক জীবনমানের উন্নতি ঘটেনি চট্টগ্রামবাসীর।
গত ১৫ বছরে তিন মেয়র মিলেও নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ একটি খালই খনন করতে পারেননি। অথচ এই খালের দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ৩ কিলোমিটার। উল্টো ২৮৯ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ব্যয় চার গুণ বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। খাল ও নালা-নর্দমা পরিষ্কারের নামে তিন মেয়র প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করলেও নগরের জলাবদ্ধতা কমেনি। উল্টো বেড়েছে। গত দেড় দশকে খাল-নালায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীসহ মৃত্যুও হয়েছে ১২ জনের। বর্জ্য সংগ্রহের নামে ঘনিষ্ঠজনদের দিয়ে হয়েছে শতকোটি টাকার ময়লা বাণিজ্য। সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ফুটপাত, সড়ক বিভাজক, সড়কদ্বীপ ও গোল চত্বরগুলোতে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে দলীয় প্রতিষ্ঠানকে। এমনকি ২৬০ কোটি টাকায় সড়কবাতি স্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ কাজটিও পায় আগে থেকেই নিম্নমানের কাজে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান।
আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে চট্টগ্রামে মেয়র ছিলেন যথাক্রমে এম মনজুর আলম, আ জ ম নাছির উদ্দীন ও রেজাউল করিম চৌধুরী। তিন মেয়রের মধ্যে সবচেয়ে কম টাকার কাজ হয়েছে বিএনপি সমর্থিত মেয়র মনজুর আলমের সময়। বিরোধী দলের মেয়র হওয়ায় তাঁর সময়ে ৯০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়। নাছিরের আমলে হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকার কাজ। রেজাউলের সাড়ে তিন বছরেই হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকার কাজ। টাকার অঙ্ক কমবেশি হলেও একটা জায়গায় মিল ছিল তিন মেয়রেরই। পছন্দের ঠিকাদারের মাঝেই কাজ ভাগাভাগি করে দিতেন তারা। তিন আমলে হওয়া ৮ হাজার কোটি টাকার কাজই তাই পেয়েছেন তাদের পছন্দের ঠিকাদার।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক মু. সিকান্দার খান সমকালকে বলেন, হাজার হাজার কোটি টাকা খরচের পরও বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম। এখানে খালে কিংবা নালায় পড়ে ভেসে গেছে এক ডজনেরও বেশি মানুষ। এটির দায়ও স্বীকার করেনি কেউ। উন্নয়ন কাজের নামে পছন্দের ঠিকাদার বেছে নিতেন মেয়ররা। ঠিকাদারের কাছ থেকে বিনিময়ে কমিশন ভোগের অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। তাই কাঙ্ক্ষিত নাগরিক সেবা পায়নি চট্টগ্রামবাসী।
সুশাসনের জন্য নাগরিক চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, ৬০ লাখ মানুষের নাগরিক সেবা নিশ্চিতে প্রধান প্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশন। কিন্তু গত ১৫ বছরে তিনজন মেয়র দায়িত্বে থাকলেও তারা তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। রুটিন ওয়ার্ক করে সময় পার করেছেন মনজুর আলম। পছন্দের লোকজনকে করপোরেশনে জায়গা ইজারা দিয়ে অনিয়ম করেছেন নাছির উদ্দীন। স্বল্প সময়ের জন্য প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে খোরশেদ আলম সুজনও তৈরি করেছেন বিতর্ক। সর্বশেষ সাড়ে তিন বছরে গৃহ কর ইস্যুতে ঘুষের হাট বসিয়েছেন রেজাউল করিম চৌধুরী।
এই তিন মেয়রের মধ্যে এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন নাছির উদ্দীন ও রেজাউল করিম। নানাভাবে চেষ্টা করেও সাবেক এই দুই মেয়রের বক্তব্য পাওয়া সম্ভব যায়নি। তবে সাবেক মেয়র এম মনজুর আলম বলেন, ‘আমি বিএনপিদলীয় মেয়র ছিলাম। তখন সরকারে ছিল আওয়ামী লীগ। চাহিদামতো সহায়তা পাইনি। তবু অনিয়ম-দুর্নীতির কোনো অভিযোগ ওঠেনি আমার বিরুদ্ধে। এটা ঠিক যে, কিছু বিষয়ে সীমাবদ্ধতা ছিল।’
মূল কাজে ব্যর্থ তিন মেয়রই
২০১০ সালের জুনে সিটি নির্বাচনের দু’দিন আগে জলাবদ্ধতায় নগরের অধিকাংশ এলাকা ডুবে যায়। নগরের প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রতিশ্রুতিকে কাজে লাগিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন মনজুর আলম। কিন্তু দৃশ্যমান কোনো উন্নতি তিনি করতে পারেননি। নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০১৪ সালের জুনে ২৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে বারইপাড়া খাল খনন প্রকল্পের অনুমোদন দেয় সরকার। এক দশকে প্রকল্পটির ব্যয় চার গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে পারেননি কোনো মেয়র। প্রকল্পের কাজ এখনও মাঝপথে। তিন মেয়র খাল, নালা-নর্দমা পরিষ্কারের নামে অন্তত পাঁচশ কোটি টাকা ব্যয় করেছেন। কিন্তু নগরের জলাবদ্ধতা কমেনি। উল্টো গত দেড় দশকে খাল-নালায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীসহ ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে একজনের খোঁজ মেলেনি। আহত হয়েছেন আরও অনেকে।
সড়কবাতি ও সড়কের কাজ নিয়েও নয়ছয়
সড়কবাতি স্থাপন সিটির গুরুত্বপূর্ণ কাজের একটি। কিন্তু তা নিয়েও হয়েছে অনিয়ম। ২০২০ সালে জাইকার অর্থায়নে নগরের ৭৫ কিলোমিটার সড়কে এলইডি বাতি স্থাপনে এইচটিএমএস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগ। কাজটি বাস্তবায়ন করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ট্রেড ম্যাজেস্টিক। ৪১ কোটি ৮৩ লাখ টাকায় কাজটি গুণগত মানের প্রমাণ মিলে সিটি করপোরেশনে তদন্তে। নিম্নমানের কাজে অভিযুক্ত ঠিকাদারকেই পরবর্তীকালে ভারতীয় অর্থ সহায়তায় ২৬০ কোটি টাকায় নেওয়া ‘মর্ডানাইজেশন অব সিটি স্ট্রিট লাইট সিস্টেম অ্যাট ডিফারেন্ট এরিয়া আন্ডার চিটাগং সিটি করপোরেশন’ শীর্ষক প্রকল্পে উপঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কাজটি পাইয়ে দিতে কলকাঠি নাড়েন প্রকল্পটির পরিচালক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ।
নগরের সড়কগুলো সংস্কারে গত দেড় দশকে অন্তত ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে চসিক। বছর না যেতেই সড়কগুলো বেহাল হয়ে পড়ে। সড়কগুলো টেকসই না হওয়ায় বিপুল টাকা গচ্চা গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিম্নমানের কাজের কারণে প্রতিবছর শতকোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে।
মনজুরের পাঁচ বছরে হয়েছে রুটিন ওয়ার্ক
২০১০ সালের ১৭ জুন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে হারিয়ে বিএনপির সমর্থন নিয়ে এক লাখ ভোটের ব্যবধান নিয়ে মেয়র হয়েছিলেন মনজুর আলম। প্রধান দুটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল জলাবদ্ধতা নিরসন ও পরিচ্ছন্ন নগরী। নির্বাচিত হয়ে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করলেও এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারেননি তিনি। অনিয়ম-দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ না থাকলেও শেষ পর্যন্ত ১৫০ কোটি টাকা বকেয়া রেখেই করপোরেশন ছাড়েন তিনি।
নাছিরের আমল ছিল বিতর্কিত
২০১৫ সালের ২৬ জুলাই দায়িত্ব নেওয়ার পর নগরের প্রায় ৫ হাজার বিলবোর্ড উচ্ছেদ করে সুনাম কুড়িয়েছিলেন আ জ ম নাছির উদ্দীন। সপ্তম শ্রেণিপড়ুয়া সন্তানকে দেড় কোটি টাকা দামের গাড়ি উপহার দিয়ে শুরু হয় তাঁর সমালোচনা। এর পর দলীয় কর্মীদের উন্নয়ন কাজের টেন্ডার দিয়ে বিতর্কে জড়ান। নগরের গুরুত্বপূর্ণ পোর্ট কানেকটিং সড়ক (পিসি) সংস্কার কাজ দেন দুই আওয়ামী লীগ নেতাকে। মাঝপথে কাজ রেখে পালিয়ে যান তারা। সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ফুটপাত, সড়ক বিভাজক, সড়কদ্বীপ, গোলচত্বরগুলোতেও পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসা করার সুযোগ দেন তিনি। নগরের ২ নম্বর গেটের বিপ্লব উদ্যানকে ২০ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়। উন্মুক্ত এই উদ্যানে সবুজ ধ্বংস করে নির্মাণ হয় দ্বিতল বিপণিবিতান। এ ছাড়া নগরের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আবর্জনা পরিষ্কারের জন্য ২ হাজার লোক নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব নিয়োগের বিপরীতে ৫০ কোটি টাকা অর্থ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে নিয়োগ-সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।
রেজাউলের সাড়ে তিন বছর
২০১৬ সালে গৃহ কর পুনর্মূল্যায়ন করেন সাবেক মেয়র নাছির উদ্দীন। এতে ১ হাজার শতাংশ পর্যন্ত গৃহ কর বেড়ে যায়। নগরবাসীর আন্দোলনের মুখে তা স্থগিত করে মন্ত্রণালয়। ২০২১ সালের ২৫ জুলাই দায়িত্ব নেওয়ার পর মেয়র রেজাউল করিমের আবেদনের ভিত্তিতে স্থগিতাদেশ তুলে নেয় মন্ত্রণালয়। নগরবাসীর আপত্তির মুখে আপিলের মাধ্যমে গৃহ কর কমানোর প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। কিন্তু নগর পুলিশের বিশেষ শাখার একটি প্রতিবেদন বলছে, আপিলের নামে চলে ঘুষবাণিজ্য। ২০২২ সালের ৪ জানুয়ারি ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতায় এয়ারপোর্ট রোডসহ বিভিন্ন সড়কসমূহ উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন পায়। আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি ঘিরে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে রেজাউলসহ প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। প্রকল্পের শুরুতেই সরকারি ক্রয়বিধি অনুযায়ী টেন্ডার আহ্বান করে ঠিকাদারদের মারধরের শিকার হন প্রকল্প পরিচালক। এটির বিচার না করে উল্টো ঠিকাদারদের ইচ্ছা অনুযায়ী এ প্রকল্পের টেন্ডার দেন রেজাউল করিম।
গত ২০১৬ সালে ঘরে ঘরে গিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ করতে ২ হাজার ৬৫ জন শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়। বছরে তাদের বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় হয় ৫০ কোটি টাকা। কিন্তু মেয়র বর্জ্য সংগ্রহের কাজ ঘনিষ্ঠজনদের দিয়ে শতকোটি টাকা ‘ময়লা বাণিজ্য’ করার সুযোগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ডিজিটাল হোল্ডিং নম্বরপ্লেটের নামেও তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের দেদার চাঁদাবাজি করার সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি। অস্থায়ী ভিত্তিতে তিন শতাধিক কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে সাবেক এই মেয়র সিটি করপোরেশনের ওপর আর্থিক বোঝা যেমন চাপিয়েছেন, তেমনি হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন