আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় ঘুরেফিরে দায়িত্ব পালন করেছেন দলের অনুগত কিছু কর্মকর্তা। পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) থেকে শুরু করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা (এসবি) এবং বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে তাদেরই ঘুরেফিরে পদায়ন করা হয়েছে। ওই সব পদে থেকে তারা সরকারের নানা রকম গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন, নিয়ন্ত্রণ করেছেন পুরো পুলিশ বাহিনীকে। সরকারের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ থাকায় অনৈতিক কর্মকাণ্ড মেনে নিতে না পারলেও প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না অন্যদের।
প্রভাবশালী এই পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনৈতিকভাবে বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এই তালিকায় এক নম্বরে রয়েছেন বর্তমানে বিদেশে থাকা সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। সেই সঙ্গে নানা ঘটনায় আলোচনায় থাকা অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ ও বিপ্লব কুমার সরকারকে সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা গেছে। সরকার পতনের পর তাদের আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। এ ছাড়া পুলিশের এসবির প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মনিরুল ইসলাম, উপমহাপরিদর্শক সৈয়দ নুরুল ইসলামরা ছিলেন সরকারের বিশেষ আস্থাভাজন। তারাসহ অনুগত অন্য পুলিশ কর্মকর্তারা নানাভাবে অনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন। তাদের অনেকেই ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ছিলেন। বলা হয়, তারা পুলিশে এসেও ‘পুলিশ লীগ’ গঠন করেছিলেন। মূলত তারাই বাহিনী পরিচালনা করতেন। আবার ডিএমপিতে ছিল মুখচেনা কিছু পুলিশ কর্মকর্তার প্রভাব বলয়। তারা ঢাকার বাইরের কোনো পেশাদার কর্মকর্তাকে ডিএমপিতে বদলি বা পদায়নের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতেন। এতে তাদের পক্ষে পছন্দমতো পদ বাগিয়ে নিতে সুবিধা হতো। আলোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তাদের বেশির ভাগকেই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা সমকালকে বলেন, পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে দায়িত্ব পালনের জন্য সব কর্মকর্তারই কমান্ডিং পজিশনসহ (নেতৃত্ব দেওয়ার মতো পদ) বিভিন্ন পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা থাকা দরকার। শুধু এক দল কর্মকর্তা সেসব পদ দখল করে রাখলে সেটি হবে না। এমনটি হয়ে থাকলে বলতে হবে, প্রশাসন ঠিকভাবে কাজ করেনি। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণও থাকতে পারে। এটা প্রশাসনের জন্য ভালো নয়।
নেতৃত্বদানকারী পদে ছিলেন যারা
আইজিপি, র্যাব মহাপরিচালক, ডিএমপি কমিশনার– গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পদেই দায়িত্ব পালন করেছেন বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হয়ে আলোচনায় আসা বেনজীর আহমেদ। তিনি ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি এবং ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন। এর আগে ছিলেন ডিএমপি কমিশনার।
আওয়ামী লীগের অনুগত আরেক সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক এখন হত্যা মামলায় কারাগারে। তিনি ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আইজিপি হিসেবে নিয়োগ পান। অবসরে যান ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি। এর আগে তিনি সচিব পদমর্যাদায় পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন ও অপারেশন) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি ডিএমপি কমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
সরকার পতনের সময় আইজিপির দায়িত্বে থাকা চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব নেন। গত বছরের ১১ জানুয়ারি তাঁর অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। তবে তাঁর মেয়াদ বাড়িয়ে চলতি বছরের ১১ জুলাই পর্যন্ত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় সরকার। পরে আবারও এক বছর মেয়াদে তাঁকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে তিনি র্যাব মহাপরিচালক এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে ছিলেন ঢাকা ও ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি।
সর্বশেষ ডিএমপি কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা হাবিবুর রহমান ছিলেন সরকারের আস্থাভাজন পুলিশ কর্মকর্তা। কমিশনার হওয়ার আগে তিনি ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান ছিলেন। ডিএমপির উপকমিশনার (সদরদপ্তর), ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার, ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ও পুলিশ সদরদপ্তরে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন এই কর্মকর্তা।
পুলিশের বহুল আলোচিত-সমালোচিত কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, যিনি ডিবিপ্রধান থাকার সুবাদে ‘ডিবি হারুন’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তিনি গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার এবং তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার ও অতিরিক্ত উপকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ৩১ জুলাই তাঁকে ডিবি থেকে সরিয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনারের (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁর বিপুল সম্পদের খতিয়ান এরই মধ্যে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিরোধী দলের হরতাল চলাকালে বিএনপি নেতা জয়নুল আবদিন ফারুককে মারধরের ঘটনায় আলোচিত হন তিনি।
একই ঘটনায় আলোচিত আরেক পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকার। তখন তিনি ডিএমপির সহকারী কমিশনার ছিলেন। সর্বশেষ ডিবির যুগ্ম কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার, তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার ও রংপুরের পুলিশ সুপার ছিলেন। এ ছাড়া তিনি পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন।
আরেক প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা সৈয়দ নুরুল ইসলাম। তিনি ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি, রমনা, মতিঝিল ও ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার এবং নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লার পুলিশ সুপার ছিলেন। এ ছাড়া এসবিতেও ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় স্যার এ এফ রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং পরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন নুরুল ইসলাম।
পুলিশের আলোচিত এক কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম। ক্ষমতাধর এ কর্মকর্তা সর্বশেষ এসবির প্রধান ছিলেন। এর আগে তিনি সিটিটিসি ও ডিবিপ্রধান ছিলেন। তিনি উপকমিশনার থেকে অতিরিক্ত কমিশনার হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ বছর ডিবিতেই কাটিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তাঁর কার্যালয় থেকে ২৫ কোটি টাকা লুটের অভিযোগ ওঠে। বলা হচ্ছে, ছাত্র আন্দোলন দমাতে পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রণোদনা হিসেবে দেওয়ার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ওই টাকা নিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের শেষ সময়ে সিআইডিপ্রধান হিসেবে থাকা মোহাম্মদ আলী মিয়া এর আগে ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান, এসবির ডিআইজি, ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি, নরসিংদী, হবিগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের জেলা পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন।
সংখ্যাতিরিক্ত (সুপারনিউমারারি) অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া আবদুল বাতেন রংপুর ও রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকায় ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার ও যুগ্ম কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মে মাসে তাঁর বিরুদ্ধে সুনামগঞ্জে গিয়ে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে।
সিটিটিসিপ্রধান হওয়ার আগে অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান এসবির উপমহাপরিদর্শক (চলতি দায়িত্ব), ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি ছিলেন। তিনি বগুড়া ও সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার, পুলিশ সদরদপ্তর এবং ডিএমপির সহকারী কমিশনার, অতিরিক্ত উপকমিশনারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন।
অবসরে যাওয়া সাবেক দুই ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও মোহা. শফিকুল ইসলাম ছিলেন সরকারের বিশেষ সুনজরে। তাদের মধ্যে আছাদুজ্জামানকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ডিএমপি কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। পরে তাঁকে জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অবৈধভাবে তিনি বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
শফিকুল ইসলাম ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ডিএমপি কমিশনার ছিলেন। অবসরের পর তাঁকে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। এর আগে তিনি অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) ও সিআইডিপ্রধান ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কমিশনার এবং চট্টগ্রাম ও ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
অবসরে যাওয়া আরেক ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক ২০২২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি চট্টগ্রাম ও রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি, ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে পাঁচ জেলার পুলিশ সুপার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে র্যাব-১০ এর অধিনায়কের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ ওঠে। আন্দোলন দমাতে তিনি নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালানোর নির্দেশ দেন বলে দাবি করা হচ্ছে। তিনি এর আগে সিলেটের পুলিশ সুপার ও ঢাকা মহানগর পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার ছিলেন।
আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের আরেকজন হলেন পুলিশ সদরদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (সুপারনিউমারারি অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক) আনোয়ার হোসেন। তিনি গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার ও চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি ছিলেন। এ ছাড়াও পুলিশ সদরদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খন্দকার লুৎফুল কবির, ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মীর রেজাউল আলম, নোয়াখালী পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির রয়েছেন তালিকায়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন