কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের ৬৭ কারাগারে (নরসিংদী ছাড়া) আটক ‘ভিআইপি’ বন্দীদের ওপর নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন কারাগার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এসব বন্দীর মনোনীত অনেক কারারক্ষী এবং কারা কর্মকর্তারা দেশের বিভিন্ন কারাগারে জেলার, জেল সুপার থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ পদে ডিউটি করছেন। তাদের মাধ্যমে বন্দীরা অবৈধ সুযোগ সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করবেন। অভিযোগ রয়েছে, কারাগারে আটক বন্দীদের মধ্যে (ভিআইপি হিসেবে পরিচিত) এখনো অনেকেই দিব্যি আরাম আয়েশে থাকার পাশাপাশি নানা কৌশলে মোবাইলফোন, ল্যাপটপ ব্যবহার করে সন্ত্রাসী, রাজনীতিসহ বাইরের নানাজগৎ নানাভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। অবৈধ উপায়ে এসব মোবাইল ফোনগুলো কোনো না কোনোভাবে কারারক্ষী অথবা কিছু কারা কর্মকর্তার মাধ্যমেই কারাগারের সেলে প্রবেশ করানো হচ্ছে।
সর্বশেষ কারা বিদ্রোহের ঘটনার পর কাশিমপুরের হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে যৌথবাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালান। এসময় মেজর সিনহা হত্যা মামলার প্রধান আসামি টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপের সেল থেকে তিনটি আইফোন ও ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়েছিল বলে কারাগার সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। শুধু ওসি প্রদীপের সেল থেকেই মোবাইলফোন উদ্ধার হয়েছে তা নয়, কাশিমপুর কারাগারে থাকা মহিলাসহ চারটি কারাগারে মাদক, মোবাইল নানা উপায়ে প্রবেশ করানো হচ্ছে। এর মধ্যে গত ৬ সেপ্টেম্বর আরপি গেটের সামনে থেকে এক কেজি গাঁজাসহ এক কারারক্ষীকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
কারাগার সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী নাম না প্রকাশের শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব কারাগারের ভেতরেই মেডিক্যালসহ বিশেষ বিশেষ সেলে থাকা বন্দীদের হাতে কমবেশি মোবাইলফোন রয়েছে। কারা কর্মকর্তা কর্মচারীদের মাধ্যমে এসব মোবাইলফোন কোনো না কোনোভাবে বন্দীদের হাতে চলে গেছে। তাদের দাবি, ওইসব মোবাইলফোন ব্যবহার করেই বন্দীরা সময় সুযোগ বুঝে বাইরে কথা বলছেন। এই বিষয়টি না-কি কারাগারে অনেকটা ওপেন সিক্রেট বলে ওই সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।
কারা বিশ্লেষক ও সাবেক ডিআইজি প্রিজন মেজর (অব:) সামছুল হায়দার সিদ্দিকী গত সপ্তাহে নয়া দিগন্তকে বলেন, এই মুহূর্তে যেসব রাজনৈতিক বন্দী পুলিশের হাতে আটক রয়েছেন তাদের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হবে। এসব রাজবন্দীর অনেকের নিজস্ব কর্মকর্তা কর্মচারী কারাগারে জেলার, সুপার থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদে ডিউটি করছেন। তাদের মাধ্যমে বন্দীরা নানাভাবে সুযোগ সুবিধা নিবেন এটাই স্বাভাবিক। তার মতে, কারাগারের পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য অবশ্যই ওই সব কারা কর্মকর্তা কর্মচারীদের ওপর নজরদারি বাড়ানো উচিত। যাতে তাদের মাধ্যমে বন্দীরা অনৈতিক কোনো বাড়তি সুবিধা না নিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে না পারে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বর্তমান আইজি প্রিজন নতুন যোগ দিয়েছেন। তিনি পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে চাইলেও দুর্নীতিবাজ কারা কর্মকর্তা কর্মচারীরা কিন্তু তাদের মতো বন্দীদের সুযোগ সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করবেন।
কাশিমপুর কারাগারের একাধিক কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, কাশিমপুর মহিলা কারাগারে রয়েছেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। ইতোমধ্যে আরো অনেক ভিআইপি ও ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দী ঢাকাসহ বিভিন্ন কারাগারে রয়েছেন। তাদের ডিভিশনও দেয়া হয়েছে। তাদের মতে, কারাগারে যাতে মোবাইলফোন নিয়ে কোনো কারারক্ষী প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য কয়েক দিন পর পরই সেলে সেলে তল্লাশি অভিযান চালানো দরকার। তারা আরো বলেন, শুধু কারারক্ষীদের তল্লাশি করলে হবে না। এখন থেকে কারাগারের ভেতরে কোনো কর্মকর্তাও যেন মোবাইলফোন নিয়ে ঢুকতে না পারে সেজন্য আইজি প্রিজন্সের নির্দেশে মেইন গেটে তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মনিটরিং টিম গঠন করে দেয়া হোক। এসময় প্রশাসনের যেই হোন তাদের অবশ্যই তল্লাশি করতে হবে। পাশাপাশি নতুন বন্দীদের রুমে সিসি ক্যামেরা লাগানো ও তল্লাশি অভিযান চালানো হলে মোবাইল ব্যবহার কমে আসবে।
গতকাল রাত ৮টায় কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো: মোতাহের হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ প্রসঙ্গে নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা কারাগারে বন্দীদের হাতে থাকা অবৈধ মোবাইল, মাদক উদ্ধারে রুটিন সার্চ জারি রেখেছি। বিশেষ করে এন্ট্রি পয়েন্টে প্রপার সার্চ প্রতিদিন অব্যাহত রেখেছি। এরপরও পরবর্তীতে যদি ঢুকেও যায় সেই ক্ষেত্রে আমরা ভেতরে রেইড দিচ্ছি। এই সময় ২-৪টা মোবাইলফোন উদ্ধার হচ্ছে। আর স্পেশালাইজড বন্দীদের ক্ষেত্রে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। কোনো ছাড় দিচ্ছি না।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শুধু কারারক্ষীরা নয়, কারা কর্মকর্তারা কেউ কারা অভ্যন্তরে মোবাইলফোন নিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি আমি যখন কারাগার ভিজিটে যাই তখন আমার মোবাইলটাও বাইরে রেখে তারপর কারাগারে যাচ্ছি। নট অ্যালাউড। সেই ক্ষেত্রে কোনো কর্মকর্তার মোবাইল নিয়ে প্রবেশ করার কোনো সুযোগ নেই।
উল্লেখ্য ইতোমধ্যে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের রোষানল থেকে বাঁচতে ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, মন্ত্রী, এমপি, শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অনেক রাজবন্দী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ বিভিন্ন কারাগারে রয়েছেন। তাদের সবাইকে দেয়া হয়েছে ডিভিশন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন