জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা ব্যারিষ্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেছেন, চুরি, ডাকাতি, খুন করে আয় করা টাকা অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে না। তারা কি চুরির টাকা দেশের উন্নয়নে আনবে এমন প্রশ্নও রাখেন তিনি।
বুধবার (১২ জুন) রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত ‘সিপিডি বাজেট সংলাপ-২০২৪’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট শিল্পপতি সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
এতে অংশ নিয়ে অর্থনীতিবিদ এবং রাজনীতিবিদরা সুশাসন নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। বক্তব্য রাখেন সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা ব্যারিষ্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ, রাজনীতিবিদ রাজেকুজ্জামান রতন, বণিক বার্তা পত্রিকার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।
আলোচনায় অংশ নেন, সাবেক সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, সাবেক এমপি ব্যারিস্টার রূমিন ফারহানা, নারী পক্ষের সামিয়া আফরিন, ব্যবসায়ী শামস মাহমুদ প্রমুখ।
ব্যারিষ্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, আমার রাজনৈতিক জীবনে বর্তমান সময়ের মত এতটা অর্থনীতিতে দুর্বলতর পজিশন কখনো দেখিনি। ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া উচিৎ হয়নি। বাজেটে সিন্ডিকেটের অনেক প্রতিফলন হয়েছে। ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ তারই একটা। আমি যদি ট্যাক্স না দিয়ে পরের বছর ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ পাই, তাহলে আমি কেন টেক্স দেব। এই বোকামি কেন করব?
আনিসুল ইসলাম বলেন, আমরা শুনছি কানাডা, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে কারো কারো বাড়ি আছে, সেই তালিকা করা হয়। তাদের চিহ্নিত করে ধরা হচ্ছে না কেন?
তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে ২০১৮ সালে ছিল ৫৮ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। সেটি এখন বেড়ে ৮৬ হাজার কোটি টাকা। আর সব হিসাব করলে সেটি সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা। এই টাকা উদ্ধারে তেমন কিছুই করা হচ্ছে না, অথচ যারা পরিশোধ করছে, পরিশোধ করার চেষ্টা করছে তাদের ধরা হচ্ছে।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দেশের উন্নয়ন কৌশলে এক-দেড় দশক ধরে কর্মসংস্থান গুরুত্ব পাচ্ছে না। কর্মসংস্থানের সঙ্কট চলছে। এখন ৫০ শতাংশের বেশি তরুণ এ দেশে আর ভবিষ্যৎ আর দেখতে পাচ্ছে না।
তিনি বলেন, এ দেশের পরিশ্রমী উদ্যোক্তারা সোনার ডিম পাড়া হাঁস। কিন্তু এসব হাঁস জবাই করে দেয়ার চেষ্টা চলছে। ব্যবসার পরিবেশ তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু লাল ফিতার দৌরাত্ম্য তো এখনো প্রবলভাবে বিদ্যমান। তাই দেশের সম্ভাবনা এখন রাজনৈতিক অর্থনীতির লৌহ ত্রিভুজে আটকে আছে। এ ত্রিভুজ ভাঙতে গেলে বাজেটের আলোচনায় এসব সমস্যা তুলে ধরতে হবে।
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ত্রিভুজের অন্যতম উপাদান জবাবদিহিতার অভাব। এটা শুধু গণতান্ত্রিক সমস্যা নয়, অর্থনীতিকে বেগবান করার ক্ষেত্রেও এটা একটা প্রতিবন্ধকতা। দ্বিতীয়ত কৌশলগত চিন্তার অদক্ষতা। প্রবৃদ্ধির নতুন চালক তৈরির ক্ষেত্রে অদক্ষতা চরমভাবে বিদ্যমান। তৃতীয়ত, দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এখন বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রকল্প নির্বাচনে অদক্ষতা একটা মহামারীতে পরিণত হয়েছে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, আগামী অর্থবছরের (২০২৪-২৫) প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এ ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হবে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা মোট ঘাটতির ৫৩ দশমিক ৭১ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে এটি একটি অসামঞ্জস্য প্রাক্কলন। এটি অর্জনযোগ্য নয়।
রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে মোটামুটি বরাদ্দ থাকলেও সংশোধনের সময় বড় ধরনের হ্রাস করা হয়।
তিনি বলেন, সর্বশেষ এডিপির রিভিশনে দেখেছি ১৬ হাজার কোটি টাকা বাদ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ১২ হাজার কোটি টাকাই শিক্ষায়। আর ৪ হাজার কোটি টাকা স্বাস্থ্যে। এই হচ্ছে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়ার নমুনা। এডিপি সংশোধনের সময় শিক্ষাকে বেশি কর্তন করা হয়। সক্ষমতার অভাবে বরাদ্দ করা অর্থকে বাদ দেয়া হয়।
রাশেদা চৌধুরী বলেন, উপবৃত্তির ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির বিষয়টি কোনো দিন ভাবা হয়নি। নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। বেড়েছে শিক্ষা উপকরণের দাম। কিন্তু গত কয়েক বছর আগে যে উপবৃত্তি দেয়া হতো, এখনো সেই উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে, বাড়ানোর কোনো লক্ষণ নেই। কেন বাড়ছে না, বাজেটে এই প্রশ্নের উত্তর নেই।
তিনি বলেন, শিক্ষায় গবেষণা নেই। এর ফলে শিক্ষার ব্যয় ব্যহত হচ্ছে। নতুন শিক্ষকদের জন্য বেতন বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য কিছুই করা হয়নি। আবার সেখানে যাওয়ার জন্য গবেষণা নেই, যা আছে তা খুবই হতাশাজনক। কিন্তু সেটাও পূরণের কোনো লক্ষণ নেই। সারসার্জ (সম্পদ কর) দিয়ে যমুনা সেতু করেছিলাম, প্রয়োজনে শিক্ষাকে আমরা সারচার্জ দিয়ে এগিয়ে নিতে চাই। এবার একটি অতিসাধারণ বাজেট, যা আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করেনি।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে শিক্ষাকে শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ উল্লেখ করে আগামী দিনের সুনাগরিক গড়তে বিনিয়োগের কথা বলেছিলেন। গত কয়েক বছরে আমরা দেখছি বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। আবার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নপূরণের কথা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলা হলেও স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষণ নেই। বাজেটে শিক্ষায় অর্থ দেয়াকে বরাদ্দ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, বিনিয়োগ হিসেবে চিন্তা করা হয় না। অথচ কত আগে বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন
স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আলোচনায় নারী পক্ষের প্রকল্প পরিচালক সামিয়া আফরিন বলেন, দেশের নীতি-নির্ধারক, রাজনীতিবিদ ও আমলারা যদি দেশের সরকারী হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা নিতেন তাহলে ওইসব হাসপাতালে সেবার মান আরো বাড়তো।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী মনে করেন, দেশে সুশাসন (গভর্নেন্স) ঠিক হলে ৯০ শতাংশ সমস্যার সমাধান হবে।
তিনি বলেন, আমাদের অনেক জায়গায় লিকেজ (ত্রুটি) আছে। এক্সপেনডিচারে (ব্যয়ে) যেমন লিকেজ আছে, তেমনি ইনকামের (আয়ের) ক্ষেত্রেও লিকেজ আছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন