দুর্বল ব্যাংককে রক্ষা করতে গিয়ে অর্থনীতিকে ধ্বংস করা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘নীতি ধরে রাখতে হবে; সরে আসা যাবে না। নিজেদের কারণে তারল্যসংকটে থাকা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে অর্থের জোগান দেওয়া হচ্ছে। তার মানে, এক হাতে আটকে রাখছি; আরেক হাতে ছাড়ছি। তাহলে কিন্তু হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংককে এই তারল্য জোগান দেওয়া বন্ধ করতে হবে।’
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও পিআরআইয়ের যৌথ আয়োজনে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আলোচনায় এ কথাগুলো বলেন তিনি। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান।
গুলশানের পুলিশ প্লাজায় মেট্রো চেম্বারের কার্যালয়ে আজ বুধবার আলোচনাটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন মেট্রো চেম্বারের সভাপতি কামরান টি রহমান। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তার, মেট্রো চেম্বারের ট্যারিফ ও ট্যাক্সেশন কমিটির সদস্য আদিব এইচ খান। সঞ্চালনা করেন মেট্রো চেম্বারের সহসভাপতি হাবিবুল্লাহ এন করিম।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাজেটের আকার ছোট হলেও অর্থায়নে বিরাট সমস্যা রয়ে গেছে। বড় সমস্যা হচ্ছে, ব্যাংক খাত থেকে সরকারকে টাকা নিতেই হবে। আমাদের আপত্তির কিছু নাই। তবে ব্যাংকিং খাত তো সবল নয়। ব্যাংকিং খাতটা দুর্বল। চলতি অর্থবছর আমানতের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ। গত বছর তার চেয়ে কম হয়েছে। তার আগের বছর সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এবার যদি ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়, তাহলে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা আমানত আসবে। সরকার যদি সেখান থেকে ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা নিয়ে নেয়, তাহলে ব্যক্তি খাতের জন্য থাকে ২০ শতাংশ। সরকার যদি একা ব্যাংক খাত থেকে ৮০ শতাংশ ঋণ নিয়ে নেয়, তাহলে সে দেশ চলতে পারে না।’
সরকারের উদ্দেশে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আপনারা ব্যয় সংকোচনের চেষ্টা করছেন। সরকারি ব্যয় আরও ৫০ হাজার কোটি টাকা ছেঁটে ফেলেন। ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ৯০ হাজার কোটি টাকায় নিয়ে আসেন। তাহলে ব্যক্তি খাত আরও ৮০-৯০ হাজার কোটি টাকা পাবে। এতে একটা ভারসাম্য আসবে।’
ব্যক্তি খাতের উদ্দেশে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আপনারা শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল হবেন না। আপনারা বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার ব্যবস্থা করুন। আগে তো নিয়েছেন। ২৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল ব্যক্তি খাত। এখন সেটি কমে ১২ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। এটা যদি না বাড়াতে পারি, তাহলে দুটি সমস্যা থেকে যাবে। এক. ব্যক্তি খাতের ঋণের পরিমাণ কম হবে। দুই. দেশের আর্থিক হিসাব পজিটিভ করতে পারি তাহলে লেনদেন ভারসাম্যে সমস্যা সমাধান হবে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভটা ধীরে ধীরে বাড়বে। রিজার্ভ কমার মূল কারণ, আর্থিক হিসাব ঋণাত্মক হওয়া। যার বড় কারণ ব্যক্তি খাতের ঋণ পরিশোধ। ঋণ আরও নিতে হবে। এই কৌশলে গেলে লেনদেন ভারসাম্য ঠিক হবে। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে পারব। সরকার ও ব্যক্তি খাতের মধ্যে ঋণ ব্যবস্থাপনাও সামঞ্জস্য হবে। সামগ্রিকভাবে সেটি অর্থনীতির জন্য ভালো।’
ব্যাংক খাতের সংস্কার বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সংস্কার নিয়ে বাজেটে কিছু নেই। কিন্তু সংস্কার করতেই হবে। অনেক দিন ধরে এটি বকেয়া রয়ে গেছে। সরকার ব্যাংক খাতকে বড় করতে পারছে না। অথচ ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। যদিও ভারত ১০ গুণ বেশি ঋণ করছে। কারণ, তাদের ব্যাংক খাত বড়। আমাদের ব্যাংক খাত ছোট। আমরা ব্যাংক খাতের ভঙ্গুর অবস্থা থেকে সরে আসতে না পারলে বেসরকারি খাত সেভাবে ঋণ সহায়তা পাবে না। সরকারও পাবে না। তাহলে আমরা যাব কোথায়। শুধু বিদেশি ঋণের ওপর ভর করে তো চলতে পারব না। তাই অবশ্যই ব্যাংক খাতে নজর দিতে হবে। পলিসি প্যারালাইসিস হলে চলবে না।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাংক খাতের একীভূতকরণ থমকে গেছে। আমাদের কিছু তো করতে হবে।’
রাজস্ব আয়ের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রার পরও কর ও জিডিপির অনুপাত ৮ শতাংশের কম থাকবে বলে মন্তব্য করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘ভারতের কর ও জিডিপির অনুপাত ১৮ শতাংশ। আমাদেরও সে জায়গায় যেতে হবে। কাজেই এখানে মৌলিক সংস্কারের প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে, কর প্রশাসনে নজরটা দিতে হবে। অটোমেশন করতে হবে। আমরা যদি ৫-১০ বছরে কর-জিডিপি অনুপাত ১৮ শতাংশে নিতে পারি, তাহলে আমাদের কোনো ঘাটতি থাকবে না। তখন আমরা শিক্ষা খাতের ব্যয় দ্বিগুণ করতে পারব। স্বাস্থ্য খাতে তিন গুণ ব্যয় করতে পারব। পৃথিবীর অনেক দেশেই কর-জিডিপি অনুপাত ১৮-২২ শতাংশ। নেপালের মতো দেশে ২০ শতাংশের ওপর। কেন আমরা ৭-৮ শতাংশে বসে থাকব।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন