শুরুতে ধু ধু মরুভূমিতে রাত্রিযাপন, তারপর বাড়ির ছাদে। এখন একটি কক্ষে ঠাঁই হলেও বের হওয়ার উপায় নেই। সকালের খাবার জুটলেও দুপুর ও রাতের খাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা। উপার্জনের বদলে গচ্ছিত টাকা খরচ করে এখন নিঃস্ব। ভাগ্য বদলের বিপরীতে অসহায়ত্ব যার সঙ্গী। বলছি সৌদি আরবের জিজান শহরের একটি কক্ষে অবস্থানরত প্রবাসী শহীদ মোল্লার কথা। যিনি দালালের খপ্পরে পড়ে বিদেশ গিয়ে এখন বেঁচে থাকার লড়াই করছেন। এই রেমিট্যান্স যোদ্ধা সব হারিয়ে এখন দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন।
শহীদ মোল্লার বাড়ি (৩৫) নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার পাংখারচর ইউনিয়নের উত্তরপাড়া গ্রামে। বাড়িতে স্ত্রী ও দুই সন্তান রেখে ২০২২ সালের ১২ জুলাই লোহাগড়ার রোমান শেখের মাধ্যমে তিনি সৌদি আরবে পাড়ি জমান।
যাওয়ার আগে রোমান শেখ তার কাছ থেকে দালাল ৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে দাবি তার। এছাড়াও সৌদি আরবে নিয়ে তাকে থাকা-খাওয়া ও কাজ খুঁজে দেবেন। সেই আশ্বাসে তিনি এনজিও থেকে ঋণ করে তাকে টাকা দেন। বিদেশে নেওয়ার পর রোমান শেখ তাকে দাম্মামের একটি মরুভূমিকে কাজের জন্য নিয়ে যান। এক সপ্তাহ কাজ করার পর রোমান শেখ তাকে রেখে পালিয়ে যায়। তখন থেকে শহীদ মোল্লা টিকে থাকার যুদ্ধ করে যাচ্ছেন।
শহীদ মোল্লা দেশ রূপান্তরকে বলেন, রোমান শেখ আমাকে তিন মাসের আকামা করে দেয়। সেটাও সৌদিতে আসার পর জোর করে নিতে হয়েছে। আকামা দিলেও কাজ খুঁজে দেয়নি। বরং সাত দিনের মাথায় মরুভূমিতে রেখে পালিয়ে যায়। আমি আরবি না জানায় কেউ আমাকে কাজ দিতে চায় না। বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে আমাকে চলতে হয়েছে এখনও চলতে হচ্ছে। মাঝে কিছুদিন কাজ করেছি তবে গত ১৫ মাস ধরে আমি অবৈধ হিসেবে এদেশে অবস্থান করছি। গ্রেপ্তার আতঙ্ক নিয়ে রাতের বেলা বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করি। যাতে কিছু উপার্জন করে অন্তত এখানে বেঁচে থাকতে পারি। টাকা না থাকায় আমি নতুন করে আকামা করতে পারছি না, আবার আউট পাস নিয়ে দেশেও ফিরতে পারছি না। এখন আমার জীবন কাটছে বন্দিশালার মতো।
তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, ‘দেশে থাকতে অন্তত তিনবেলা খেতে পারতাম। এখন তিনবেলার জায়গায় দুইবেলা খেতে হয়, পালিয়ে বেড়াতে হয় এক শহর থেকে আরেক শহরে। আমার মতো স্ত্রী-সন্তানরা মানবেতর দিন পার করছে। বাড়িতে থাকতে ভ্যান চালিয়ে হলেও সংসার চলতো। এখন আমার মাদ্রাসা পড়ুয়া ছেলের পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেছে। এনজিওর অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় তারা আমাদের বাড়িতে গিয়ে নানা হুমকি-ধামকি দিয়ে আসে।
শহীত মোল্লা বলেন, ‘আমার সঙ্গে আরও পাঁচজন বন্দিজীবন কাটাচ্ছে। রোমান শেখ একজন দালাল। আমার মতো পাঁচজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সৌদি আরবে নিয়ে আসে। সবার অবস্থা এখন আমার মতো। আমি এখন দেশে ফিরতে চাই। সরকারের সহযোগিতা চাই। আমার পাসপোর্ট নম্বর: অ০১০৬৪৭৯৮।’
সৌদি প্রেস এজেন্সি সূত্রে জানা গেছে, আবাসন, শ্রম ও সীমান্ত নিরাপত্তা বিধি লঙ্ঘনের অপরাধে গত মাসে ১৯ হাজার ৩২১ জন অভিবাসীকে গ্রেপ্তার করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। আবাসন আইন ভাঙার অপরাধে সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৪২৭ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছে ৪ হাজার ৬৯৭ জন। কাজ সম্পর্কিত অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছে ৩ হাজার ১৯৭ জন।
গত এক সপ্তাহে ৯ হাজার ৯২৭ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এ প্রবাসীদের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের আবাসন, শ্রম ও সীমান্ত আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। গত ৪ থেকে ১০ জানুয়ারি সৌদির বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
আবাসন, শ্রম ও সীমান্ত আইন লঙ্ঘনের দায়ে সৌদি আরবে বর্তমানে ৫৪ হাজার ৪৪৯ জনের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া চলছে। আটককৃত প্রবাসীদের মধ্যে ৪৭ হাজার ৯৭৭ জনকে দেশে ফেরত পাঠানোর আগে ভ্রমণের প্রয়োজনীয় নথি সংগ্রহের জন্য তাদের নিজ নিজ কূটনৈতিক মিশনে পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেক বাংলাদেশি রয়েছেন বলে জানা গেছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন