দুবাই কপের প্রথম দিনই ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ (ক্ষয়ক্ষতি) তহবিলের বিষয়ে ঐকমত্য এ বছরের বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলনকে দুর্দান্ত শুরু এনে দিয়েছে। এই তহবিলের জন্য দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে লড়াই করে আসছিল জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা ছোট দ্বীপদেশগুলো। তাদের জন্য চলতি বছর নভেম্বরের শেষ দিনটি এসেছিল আশার পরশ হয়ে।
এত দিনে ঐকমত্য হলেও এই তহবিলের প্রথম ঘোষণা অবশ্য এসেছিল গতবারের মিসর সম্মেলনেই।
কিন্তু এতে অর্থায়ন হবে কিভাবে, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো কিভাবে অর্থ পাবে, তহবিলের ব্যবস্থাপকই বা কারা থাকবে—এসব নিয়ে মতপার্থক্য ছিল। এবার সম্মেলনের কয়েক সপ্তাহ আগে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে খানিকটা সরে গিয়ে ঐক্যের পথ প্রস্তুত করে।
এখনই জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাবের মুখোমুখি হওয়া দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ বাবদ লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল থেকে অর্থ দেওয়া হবে। ক্ষতিপূরণ দেবে ধনী দেশগুলো, মূলত যাদের শিল্পায়নের ফলেই বৈশ্বিক উষ্ণতাজনিত সংকট সৃষ্টি হয়েছে, ধরিত্রী আর গোটা প্রাণিকুল পড়েছে বিপদের মুখে।
তুলনামূলকভাবে অনেক কম কার্বন নিঃসরণ করেও সবচেয়ে বেশি ভুগতে হচ্ছে দরিদ্র দেশগুলোকে। মুখোমুখি হতে হচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, একের পর এক তুমুল বন্যা, ঝড় ও খরার।
শিল্প, পরিবহনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপুল জীবাশ্ম জ্বালানির দহন থেকে তৈরি হয় কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ বিভিন্ন গ্যাস। এই গ্যাস বায়ুমণ্ডলে স্তরের মতো জমা হয়ে পৃথিবীর তাপ বাইরে বিকিরিত হতে দিচ্ছে না।
এতে এই গ্রহের উষ্ণতা ধীরে ধীরে বেড়ে যাওয়াতেই জলবায়ু পরিবর্তিত হয়ে ঘটছে পরিবেশ বিপর্যয়।
ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতে প্রাণ, জীবিকা, জীববৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইত্যাদি সব কিছুকে বিপন্ন করে তোলার দায় মেটাতে শেষ পর্যন্ত শিল্পোন্নত দেশগুলো রাজি হলেও তহবিলে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ অর্থের প্রতিশ্রুতি মিলেছে, তা নগণ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জেমস রাইজিংয়ের কয়েক দিন আগের গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শুধু ২০২২ সালেই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রায় দেড় লাখ কোটি ডলার। আর তহবিলে এখন পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি মিলেছে মাত্র ৪৭ কোটি ৫০ লাখ ডলারের মতো। এর মধ্যে এবারের কপের আয়োজক সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) আর জার্মানি ১০ কোটি করে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন সাড়ে ২২ কোটি ডলার দিতে রাজি হয়েছে।
যুক্তরাজ্য এ তহবিলে দিচ্ছে চার কোটি, তহবিল ব্যবস্থাপনায় আরো দুই কোটি, আর অন্যতম শীর্ষ দূষণকারী যুক্তরাষ্ট্র দিচ্ছে মাত্র এক কোটি ৭০ লাখ ডলার। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই তহবিলে শুরুতেই বছরে অন্তত ৪০ হাজার কোটি ডলার দরকার। ১০ হাজার কোটি ডলার বা তার নিচে থাকলে এই ক্ষতিপূরণ লোক-দেখানোই হবে, কোনো কাজে আসবে না।
তহবিলটির পরিচালনা পদ্ধতিও এখন পর্যন্ত ধোঁয়াশাপূর্ণ। ধনী দেশগুলো অন্যান্য জলবায়ু অর্থায়ন এবং উন্নয়ন সহযোগিতার অর্থ এই তহবিলে যোগ করে দেয় কি না, তা নিয়েও সংশয়-শঙ্কা আছে। শুরুতে তহবিলটি দেখভালের দায়িত্বে থাকবে বিশ্বব্যাংক। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, তহবিলের ব্যবস্থাপনায় ধনী দেশগুলোরই নিয়ন্ত্রণ থাকছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্বব্যাংককে এই ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিতে নারাজ ছিল, পরে অন্তত তহবিলের যাত্রাটা শুরু হোক—এই বিবেচনায় এই ইস্যুতে ছাড় দেয় তারা।
তবে এখানেই থামতে নারাজ তহবিলের জন্য দীর্ঘদিন ধরে চিৎকার করে আসা বড় ঝুঁকিতে থাকা ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলো। ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জোট অ্যাসোসিয়েশন অব স্মল আইল্যান্ড স্টেটের (এওএসআইএস) সভাপতি পাওলেলেই লুতেরু বলেন, ‘কাজ এখনো অনেক বাকি। তহবিল গঠন নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এলেও যতক্ষণ পর্যন্ত না এই তহবিল কার্যকরভাবে ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর বোঝা লাঘবে কাজ শুরু করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ পাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের থামাথামি নেই। জলবায়ু সংকটে ক্ষতিগ্রস্তরা যখন তাদের জন্য দরকারি অর্থ সরাসরি সংগ্রহের সুযোগ পাবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন তাদের পূর্ণাঙ্গভাবে সহায়তা করতে পারবে, তখনই এই তহবিলের সফলতা শুরু হবে।’
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবেলায় কাজ করা বিশ্বের প্রায় সব সংগঠনই এই ক্ষয়ক্ষতি তহবিলে ধনীদের নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ প্রদান বাধ্যতামূলক করতে চাইছে। কেউ কেউ জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করতে কার্বন ট্যাক্স নির্ধারণেরও পক্ষে। তাতে ক্ষতিপূরণের টাকা যেমন মিলবে, তেমনি জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতাও কমবে। দুনিয়াজুড়ে নবায়নযোগ্য প্রযুক্তির ব্যবহারও ত্বরান্বিত হবে। কিন্তু শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলো এ ধরনের বাধ্যতামূলক অর্থায়নের পক্ষে নয়। তারা চায় অর্থায়ন হবে ঐচ্ছিক।
বিশ্বজুড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা পাওয়ার জন্য কাজ করতে গঠিত জোট ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ কোলাবরেশন’-এর (এলঅ্যান্ডডিসি) প্রধান কৌশলবিদ জুলি-অ্যান রিচার্ডস মনে করেন, এখন পর্যন্ত যে প্রতিশ্রুতি মিলেছে, তা দিয়ে শুধু তহবিলটি গঠনের সূচনাই হলো। তিনি বলেন, ‘আপাতত একে জলবায়ু ন্যায়বিচারের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলা যেতে পারে। দ্রুতই এই তহবিল থেকে দাবদাহ, খরা, বন্যা, ঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা শুরু করা দরকার।’
বিশেষজ্ঞ, জলবায়ু আন্দোলনকর্মী, আইনজীবী, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী, সংস্কৃতিসেবীসহ বিভিন্ন পেশা ও কর্মক্ষেত্রের মানুষ এলঅ্যান্ডডিসি জোটের সদস্য। লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল থেকে অর্থ পাওয়ার সুযোগ বাংলাদেশেরও থাকছে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ শামসুদ্দোহা।
‘বিশ্বব্যাংক এখন যেসব তহবিল ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছে, নতুন এই ক্ষয়ক্ষতি তহবিলের ব্যবস্থাপনাও সে রকমই হবে। প্রাথমিকভাবে শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলো তাদের ইচ্ছানুযায়ী এখানে অর্থ দেবে। অন্য দেশগুলোর মধ্যে যাদের সক্ষমতা আছে, তারাও পারবে। ধনী দেশগুলো এখানে অনেক টাকা দেবে, এমনটা আশা করতে পারছি না আমরা। তবে জলবায়ুর কারণে ঝুঁকিতে থাকা দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এই তহবিল থেকে অর্থ নেওয়ার সুযোগ পাবে, তার অঙ্ক যা-ই হোক না কেন,’ বলেছেন মোহাম্মদ শামসুদ্দোহা।
ইয়ুথনেট গ্লোবালের প্রধান নির্বাহী সোহানুর রহমান তহবিলের জন্য এখন পর্যন্ত প্রতিশ্রুত অর্থের অঙ্ক দেখে হতাশ। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে থাকা ৫০টির বেশি দেশের জোট ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের এখনই ক্ষতিপূরণ বাবদ এক লাখ কোটি ডলার লাগে। সোহানুর রহমান বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোর বাধা টপকে ক্ষয়ক্ষতি তহবিলের সূচনা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে এখনই আনুমানিক ১০০ কোটি ডলার খরচ করতে হয়, যা আমাদের জিডিপির ১ শতাংশের কাছাকাছি। সেখানে তহবিলে পুরো বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য এখন পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি এসেছে মাত্র ৪০ কোটি ডলারের সামান্য বেশি। এর অঙ্ক দ্রুত বাড়াতে হবে, আর যাদের প্রয়োজন তাদের কাছে দ্রুত পাঠানোর ব্যবস্থাও করতে হবে।’
যুক্তরাজ্যের ডান্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাডাপ্টেশনের প্রধান নন্দন মুখার্জি বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় বিশ্ব যেসব পদক্ষেপ নিতে চায়, সেখানে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন থাকতে পারে।
‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি বাস্তব ঘটনা। বৈশ্বিক পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতির কারণে যেসব দেশ চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। এটি একটি দিক। অন্য দিকটি হচ্ছে, ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা থেকে সংকট কিভাবে দ্রুত কাটিয়ে ওঠা যায় বাংলাদেশ এখন তার উদাহরণও। ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় বৈশ্বিক পদক্ষেপের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন থাকতে পারে,’ বলেন নন্দন মুখার্জি।
আমিরাতের নতুন তহবিল ঘোষণা
এদিকে এর মধ্যে গতকাল কপ২৮ সম্মেলনের স্বাগতিক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জলবায়ু প্রকল্পের জন্য একটি নতুন তিন হাজার কোটি ডলারের বেসরকারি বিনিয়োগ তহবিল চালুর ঘোষণা দিয়েছে। গতকাল তেলসমৃদ্ধ আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান সম্মেলনে এই নতুন তহবিলের কথা ঘোষণা করেন। প্রেসিডেন্ট বলেন, তাঁরা আশা করছেন ‘আলটেরা’ নামের নতুন তহবিলটি ২০৩০ সালের মধ্যে মোট ২৫ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগকে অনুপ্রাণিত করবে।
এ ছাড়া এসংক্রান্ত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কপ২৮-এর সভাপতি আমিরাতের জাতীয় তেল কম্পানি অ্যাডনকের প্রধান সুলতান আল জাবের নতুন এই তহবিলের বোর্ডের সভাপতি হবেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তহবিলটি একটি ন্যায্য জলবায়ুু অর্থায়নের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নেবে এবং এতে বৈশ্বিক দক্ষিণের (অনগ্রসর বিশ্ব) জন্য তহবিল পাওয়ার সুযোগ বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হবে।
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মতে, চীন বাদে উদীয়মান বাজার এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোকে তাদের জলবায়ু ও উন্নয়নের চাহিদা মোকাবেলায় প্রতিবছর দুই লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে, যা বিনিয়োগের বর্তমান স্তরের অনেক ওপরে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের উদ্যোগটিকে কপ২৮-এর জন্য দেশটির বৃহত্তর কৌশলের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। স্বেচ্ছায় নিজেরা বড় অঙ্কের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পাশাপাশি এর মাধ্যমে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারতে ২০২৫ সালের মধ্যে বায়ু ও সৌর প্রকল্প নির্মাণসহ ছয় গিগাওয়াটের বেশি পরিবেশ অনুকূল জ্বালানি উৎপাদনের জন্য এরই মধ্যে অর্থ আলাদা করা হয়েছে। আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জন্য আরো প্রকল্প খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত নিজেকে কার্বন নিঃসরণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ধনী উন্নত দেশ এবং বাকি বিশ্বের মধ্যে একটি সেতু হিসেবে দেখে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন