ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের অধীনে ১৯০৭ সালে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর রেলবাজার থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা জংশন পর্যন্ত ২৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপন করা হয়েছিল। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এই লাইনটি দিয়ে কলকাতার শিয়ালদহ থেকে মুর্শিদাবাদের লালগোলা-গোদাগাড়ীর রেলবাজার-আমনুরা জংশন-রহনপুর-ভারতের মালদহ জেলার সিঙ্গাবাদ হয়ে বিহারের কাটিহার জংশনের মধ্যে নিয়মিত ট্রেন চলাচল করত।
জানা গেছে, ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের কারণে স্থায়ীভাবে এই লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গোদাগাড়ীর রেলবাজার থেকে আমনুরা জংশন স্টেশন পর্যন্ত লাইনটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। এসব রেলভূমির পুরোটাই অবৈধ দখলদারদের কবলে চলে যায়। সম্প্রতি রেল উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান পশ্চিমাঞ্চল রেল কর্তৃপক্ষকে এসব জমি দ্রুত সময়ে উদ্ধারের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে ৬০ বছর ধরে বেদখল হওয়া এসব জমি এখন কীভাবে উদ্ধার করা সম্ভব সে ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনা ঠিক করতে পারছে না পশ্চিম রেল। ফলে রেলভূমি উদ্ধার নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, গোদাগাড়ীর রেলবাজার-আমনুরা লাইনটি পরিত্যক্ত হওয়ার পর এই সেকশনের অধীন ৬টি স্টেশন, ২৩ কিলোমিটার রেললাইন, রেল গুদামসহ ২ হাজার ৩০০ বিঘা রেলভূমি অরক্ষিত হয়ে পড়ে। দীর্ঘ দিন ধরে এই লাইনের রেলের জমি বেদখল হয়েছে অবাধে। এসব জমি দখলের পর দফায় দফায় হাতবদলও হয়েছে। অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে পাকা বাড়ি-ভবন, দোকানপাট, হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে আমবাগান গোরস্থান ইত্যাদি। অভিযোগ উঠেছে, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এখন শুধু কাগজ-কলমে এসব জমির মালিক। কিন্তু জমি উদ্ধারে রেল কর্তৃপক্ষ অদ্যাবধি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। এসব জমি অস্থায়ীভাবে ব্যবহারের জন্য ইজারাও দেওয়া হয়নি। রেল কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ না থাকায় দখলদাররা অনেকেই নিজের নামে কাগজপত্র তৈরি করে নিয়েছে। সেসব জাল নথি ব্যবহার করে মোটা দামে সেগুলো হাতবদল করা হয়েছে। ভাঙন কবলিত পদ্মার চরাঞ্চল থেকে ওঠে আসা লোকজন রেলের এসব জমিতে বাড়িঘর করে বসবাস করছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, গোদাগাড়ী পৌর এলাকার মাদারপুর, রেলবাজার, ডিমভাঙ্গা, মহিষালবাড়ী, লিপস্টিটপাড়াসহ বেদখল হওয়া জমিতে ৪ হাজারের বেশি পরিবার এখন বাড়িঘর করে বসবাস করছেন। রেলগেট এলাকার ইসাহাক আলী ৩০ বছর আগে রেলের জমিতে বাড়ি করেছিলেন। তিনি এখনো সেখানেই বসবাস করছেন। তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় পশ্চিম রেলভবনে গিয়ে কর্মকর্তাদের বলেছি জমিগুলো আমাদের কাছে ন্যায্য দামে বিক্রি করতে অথবা দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দিতে। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। আমরা বসবাস করলেও আমাদের কাছে কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। আরেক বাসিন্দা তোজাম্মেল হোসেন জানান, ১৯৮৬ সালে তৎকালীন সরকারের আমলে রেল কর্তৃপক্ষ এসব জমি একটা মূল্য নির্ধারণ করে দখলদারদের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু রেল মন্ত্রণালয়ের সম্মতি না পাওয়ায় সে উদ্যোগ কার্যকর হয়নি। ১৯৯২ সালে রেল মন্ত্রণালয় বেদখল হওয়া এসব জমি উদ্ধার করে যে যেখানে বসবাস করছেন তাকে সে পরিমাণ জমি হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিলেও নানা জটিলতায় তাও কার্যকর হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এসব জমি উদ্ধারের কয়েক দফা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে জনবল সংকট দেখিয়ে জমি উদ্ধার করতে পারেনি রেল কর্তৃপক্ষ।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, শুধু গোদাগাড়ীই নয়-পশ্চিম রেলের সর্বত্রই বিপুল পরিমাণ রেলভূমি বেদখল হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মোট জমির পরিমাণ ৪০ হাজার ৪১৯ একর। এর মধ্যে ২ হাজার ৭৪৫ একর জমি বেহাত হয়ে গেছে। বাকি জমির মধ্যে ১২ হাজার ৯ একর ইজারা দেওয়া হয়েছে। বেদখল জমির আর্থিক মূল্য ১০ হাজার কোটি টাকা বলে রেলভবন সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে পশ্চিম রেলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা রেজাউল করিমকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠালেও কোনো সাড়া দেননি। একইভাবে পাকশী বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তাকেও ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে কল ও বার্তা পাঠিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি। ফলে এ বিষয়ে পশ্চিম রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বক্তব্য জানা যায়নি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন