ডিপ্লোম্যাট প্রতিবেদন
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, আমরা মর্যাদা, দায়িত্ব এবং সহানুভূতির ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি চাই। জনগণের কূটনীতির পাশাপাশি সামরিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কূটনীতি দরকার। তার এ সাক্ষাতকারটি নেন সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, নিউ দিল্লির ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স বিভাগের রিসার্চ স্কলার শাহাদাত হোসেন।
মাফফুজ আলম বলেন, অবশ্যই মুজিববাদের মতো সংঘাতময় রাজনীতির বাইরে যেতে হবে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতিকে সঙ্গী করতে হবে। ১৫ বছরের নিপীড়নমূলক রাজনীতিতে মানুষ অধিকার বঞ্চিত হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ধারাবাহিকভাবে তাদের অধিকার দাবি করেছে। অধিকার দায়িত্বের সঙ্গে আসে। আমাদের এককভাবে অধিকারভিত্তিক রাজনীতি থেকে দায়িত্বভিত্তিক রাজনীতিতে যেতে হবে। আমাদের আকাঙ্ক্ষা হলো ফ্যাসিবাদী রাজনীতি থেকে দূরে যাওয়া। জনগণের মধ্যে মতবিরোধ এবং বিভাজন তৈরি করে, তা থেকে বোঝাপড়ার রাজনীতির দিকে যাওয়া। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ের জন্য মর্যাদা,দায়িত্ব এবং সহানুভূতিশীল মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক কাঠামো চাই। আমাদের অবশ্যই মুজিববাদের মতো সংঘাতময় রাজনীতির বাইরে যেতে হবে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতিকে সঙ্গী করতে হবে। সহানুভূতি ছাড়া মানুষের সঙ্গে সংযোগ করা বা প্রকৃত অন্তর্ভুক্তি অর্জন অসম্ভব।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা কেন জুলাই-আগস্টের মতো এত বড় আন্দোলনে অংশগ্রহণে সক্ষম হয়নি? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আন্দোলনের পক্ষে কোনো প্রতিষ্ঠান দাঁড়ায়নি। মিশেল ফুকো, দেরিদা, ইকবাল আহমেদ বা ভারতের জনগণের জন্য কাজ করা বুদ্ধিজীবীরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তালিকাভুক্ত। সেখানে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের দৌড় বড় জোর সাংবাদিক, বাংলা সাহিত্য বা ইংরেজি সাহিত্যে পাণ্ডিত্য জাহির পর্যন্ত। বাংলাদেশে অসংখ্য সংকট রয়েছে, তবুও জনসাধারণের জন্য বুদ্ধিবৃত্তি ও গবেষণার অর্থপূর্ণ বিকাশ হয়নি। ছোট পরিসরে যেটুকুই হয়েছে, তা ব্যক্তিগত উদ্যোগে হয়েছে, তার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সহায়তা নেই। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে উচ্চ-মধ্যবিত্ত, শহুরে কোলাহলে থাকার প্রবণতা আছে, সাধারণ জনগণের ভাষা, চিন্তা-ভাবনা এবং জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা থেকে তারা বিচ্ছিন্ন। তারা প্রকৃতপক্ষে জনগণের মতামত নেয় না। বরং তার পরিবর্তে তারা তাদের ধারণা এবং মতাদর্শকে ‘উপর থেকে নিচে’ দৃষ্টিকোণ থেকে চাপিয়ে দিয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে তোলে, সমাজের মধ্যে আদর্শিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনগুলো ধরতে বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থ করে তোলে। আগের জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারায় আটকে থাকার ফলে এই বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই জনগণ থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছেন। রাষ্ট্র যখন জনগণের ওপর নিপীড়ন চালায় এসব বুদ্ধিজীবীর বেশিরভাগই হয় নীরবে সমর্থন দিয়েছেন বা উৎসাহ দিয়েছেন। কখনো কখনো সত্যিকার অর্থে জনগণকে বোঝার চেষ্টা না করেই তাদের বিভিন্ন তকমা দিয়েছেন। এই সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বিভাজন বুদ্ধিজীবী ও জনসাধারণের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এই বিচ্ছিন্নতার কারণে বুদ্ধিজীবীদের বেশিরভাগই ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের বিষয়টি আঁচ করতে পারেনি।
এ অঞ্চলের মানুষ যখন ধারাবাহিকভাবে লড়াই করছে, তখন মানুষ বা রাষ্ট্রের চূড়ান্ত পরিচয় কী? এ প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ আলম বলেন, অন্যান্য সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বাঙালি মুসলমান ও হিন্দুদের ঐক্যের মধ্যেই বাংলাদেশের ভিত্তি নিহিত। বাঙালি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় পরিচয়ের রাজনীতির প্রয়োজন নেই; তারা রাষ্ট্রকে স্পষ্ট করে তোলে। রাষ্ট্রের দুটি দিক: রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের বিকাশ এবং রাষ্ট্র গঠন। বাঙালি মুসলিম আকাঙ্ক্ষা থেকে রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে; কিন্তু রাষ্ট্রকে অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে হবে। রাষ্ট্রকে বাঙালি মুসলমান ও হিন্দু-সবাইকে সমান বিবেচনা করতে হবে। বাঙালি মুসলমান তাদের অধিকার আদায়ের জন্য বারবার সংগ্রাম করেছে। ১৯৪৭ সালে তারা পাঞ্জাবি আধিপত্যের কারণে সেটা অর্জন করতে পারেনি এবং ১৯৭১ সালে মুজিববাদ তাদের আবদ্ধ করে রেখেছিল। এমন একটি রাষ্ট্রের সন্ধানে তারা ২০২৪ সালে আবার জেগে ওঠে, যেটা বৈষম্যহীন, আরও বেশি গণতান্ত্রিক এবং আরও বেশি সমতার।
মাহফুজ আলম বলেন, ১৯৭১ সালের পরে একটি সমঝোতার প্রয়োজন ছিল এবং জামায়াতের সঙ্গে সমস্যাটি ২০১৪ পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হওয়া উচিত ছিল না। এখন আওয়ামী লীগের প্রশ্ন তুলে জাতীয় ঐক্যকে আরও দুর্বল করার তৎপরতা চলছে। ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশে শাহবাগ-হেফাজত দ্বন্দ্ব উবে গেছে। তবে সাংস্কৃতিক লড়াই রয়ে গেছে। শাহবাগ-হেফাজত দ্বন্দ্ব কেবল রাজনৈতিক নয়; এটি একটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব। মুজিববাদীরা এই সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বকে স্থায়ী করেছে। তারা জাতির মধ্যে বিভাজন ধরে রাখছে এবং বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি অংশের সঙ্গে মিলে অন্য অংশকে সত্যিকার অর্থে বোঝার চেষ্টা না করে প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে আখ্যা দেয়।
রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য দ্বন্দ্বের এই চক্রটি মুজিববাদীরা সাজিয়েছে। এই বিভেদ দূর করার চেষ্টা করব।
বাংলাদেশে পররাষ্ট্রনীতি কোন পথে চলবে এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা সভ্যতাগত মিশ্রণ এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোর পক্ষে কথা বলছি, যা আমাদের মধ্যে এশিয়া থেকে তুরস্ক এবং চীন থেকে কোরিয়া ও জাপানে সভ্যতাগত সংলাপের মাধ্যমে যুক্ত করে। আমি যখন সামুদ্রিক সম্পর্কের কথা বিবেচনা করি, তখন আমরা দেখতে পাই আমাদের প্রভাব শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। আমাদের নেতারা জাতীয় পরিচয় বা ঐক্যের প্রশ্নে একত্রিত হতে পারেননি, ঐক্যবদ্ধ জাতীয় চরিত্রের অনুপস্থিতির কারণে পররাষ্ট্রনীতি খুবই আজ্ঞাবহ এবং দলীয় রাজনীতি দ্বারা চালিত।
তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরের পরিচয়ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গোপসাগরের চারপাশে - চট্টগ্রাম, আরাকান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, এমনকি অস্ট্রেলিয়ার মতো জায়গায় - ২০০-৩০০ বছর ধরে একটি সাংস্কৃতিক সঙ্গম ঘটছে। বাংলাদেশ এই উত্তরাধিকারকে আলিঙ্গন করুক এবং বৈচিত্র্যময় ধর্ম, সংস্কৃতি ও ধারণার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হোক। এখানে কোনো একক মতাদর্শ আধিপত্য করতে পারে না; এই ভূমি দৃষ্টিভঙ্গির মিশ্রণে সমৃদ্ধ। এই মাটি সমৃদ্ধ - এমন একটি জায়গা যেখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান এবং বৈষ্ণবরা পারস্পরিক বোঝাপড়ায় সহাবস্থান করেছে, রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি করেছে।
কেন সমগ্র বাংলা পাকিস্তানের সাথে মিশে যায়নি? এ প্রশ্নের উত্তরে মাহফুজ আলম বলেন, পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক ও শ্রেণী বিভাজন ছিল, যা শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী ইন্ধন যোগান। বাঙালি মুসলমানরা একটি অখণ্ড বাংলাকে সমর্থন করেছিল - যে অবস্থান আমরা এখনও সমর্থন করি। আমরা আবুল হাশেমের মতো ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা করি, যারা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শরৎ বসুর সাথে অখন্ড বাংলা চেয়েছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশও বেঙ্গল প্যাক্টের মাধ্যমে অখণ্ড বাংলার পক্ষে কথা বলেন, একটি সুসংহত বাঙালি পরিচয়ের জন্য প্রয়াস চালান। আমরা চিত্তরঞ্জন দাসকে এই কাজের জন্য তার অবদানের জন্য উচ্চ শ্রদ্ধা জানাই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন