‘ক্রাউড কন্ট্রোল’ করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নামছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। প্রধান সড়ক অবরোধের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে জনদুর্ভোগ। কিন্তু দ্রুততার সঙ্গে বিক্ষোভ বা অবরোধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে নিরুপায় পুলিশকে ডাকতে হচ্ছে সেনাবাহিনীর সদস্যদের।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশকে ভীষণ ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হচ্ছে। এমনিতেই অতীত কর্মকাণ্ডের কারণে পুলিশের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে আছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে পুলিশ সদস্যদের মধ্যেও হতাশা রয়েছে। এছাড়া পুলিশের ডাকে সাড়া দিতে চাইছে না সাধারণ মানুষ। পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের ভয়ও ভেঙে গেছে। ফলে যেকোনও ক্রাউড কন্ট্রোল করতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকেই রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়। ধীরে ধীরে এই অবস্থার উন্নতি হলেও এখনও ‘মেরুদণ্ড’ সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সড়কে বিক্ষোভ শুরু করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডিএমপির পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ও সচিবালয় এলাকায় বিক্ষোভ ও মিছিল মিটিংও নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু ডিএমপির এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেও মিছিল বা বিক্ষোভ চলতে থাকে। গত কয়েক দিনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন। সেটি সমাধান করতে না করতেই তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এর আগে ঢাকার সাত কলেজের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ করেছেন। সর্বশেষ বুধবার (২০ নভেম্বর) দুপুরে তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে সায়েন্স ল্যাব এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। একই দিন সকালে যাত্রাবাড়ী এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার মালিকরাও সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেছেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর পর ডিএমপিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে ব্যাপক রদবদল করা হয়। বর্তমানে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের বেশিরভাগেরই বড় ক্রাউড কন্ট্রোলের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। এছাড়া পটপরিবর্তনের কারণে কেউ নিজে থেকে কঠোর পুলিশি অ্যাকশন নেওয়ার জন্যও নির্দেশনা দিতে চাইছেন না। এই সুযোগেই বিভিন্ন গোষ্ঠী সড়ক অবরোধ করে দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মোহাম্মদ তালেবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে প্রতিনিয়ত বোঝানোর চেষ্টা করছি যে যদি কারও কোনও যৌক্তিক দাবি থাকে— তাহলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। কারণে-অকারণে সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন না। এতে দুর্ভোগে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।’
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘অন্যান্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ক্রাউড কন্ট্রোল করাও এখন পুলিশের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
ডিএমপির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ক্রাউড কন্ট্রোল করার জন্য নিয়মিত ফোর্সদের মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। অনেক স্থানেই ফোর্সরা সিনিয়রদের নির্দেশনা সঠিকভাবে পালন করতে চাইছেন না। ক্রাউন কন্ট্রোল করতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হতে হয়। কেউ নিজ থেকে কঠোরতা দেখাতে চাইছেন না। একইসঙ্গে কোনও ঘটনায় একটু কঠোর হলেই সাধারণ মানুষ জোটবদ্ধ হয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে দিচ্ছে। এতে ফোর্স-সদস্যদের মনোবল আরও ভেঙে যাচ্ছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। যাতে কেউ অহেতুক রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি না হয়, এটা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে পুলিশ দায়িত্ব নিয়ে আইন প্রয়োগ করতে পারবে। ভবিষ্যতে যাতে কেউ যথাযথ আইন প্রয়োগের কারণে হেনস্তা বা মামলা-মোকদ্দমার মুখোমুখি না হন, সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে।
পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা জানান, ৫ আগস্টের পর থেকে পুলিশ ধীরে ধীরে সক্রিয় হয়ে উঠছে। এখন নিয়মিত টহল ও চেকপোস্টও পরিচালনা করা হচ্ছে। ট্রেডিশনাল ক্রিমিনালদের ধরতে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধের রহস্য উদ্ঘাটন করা হচ্ছে। যথাযথভাবে ট্রাফিক আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু পুলিশকে শতভাগ সক্রিয় করতে হলে জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রের নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্যই পুলিশ গঠিত হয়েছে। ফলে নাগরিকরা যদি পুলিশকে সহায়তা না করে, তাহলে পুলিশিং করা কঠিন হয়ে যাবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন