দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র ইস্যুকে আবারো সামনে নিয়ে এসেছে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের একটি বক্তব্য।
দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র ইস্যুকে আবারো সামনে নিয়ে এসেছে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের একটি বক্তব্য। এক সাক্ষাৎকারে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্রের কোনো ‘দালিলিক প্রমাণ’ তার কাছে নেই বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। তার এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় নানা বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনা দেখা গেছে গতকাল দিনভর। কড়া প্রতিক্রিয়া এসেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কসহ বিভিন্ন মহল থেকে। তবে রাষ্ট্রপতির প্রেস উইং থেকে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্রের বিষয়টি মীমাংসিত; এ নিয়ে যাতে নতুন করে কেউ বিতর্ক না ছড়ায়।
মানবজমিন পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে ১৯ অক্টোবর সাক্ষাৎকার দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সেখানে তিনি বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের কোনো দালিলিক প্রমাণ আমার কাছে নেই।’
এর আগে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্রের বিষয়টি আলোচনায় এনেছিলেন তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। গত ৯ আগস্ট রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেন, ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগে তার মা পদত্যাগ করেননি। এর পর এ ইস্যুতে রাষ্ট্রপতির সাম্প্রতিক বক্তব্যটি গতকাল আবার নতুন করে আলোচনার ঝড় তোলে।
তার এ মন্তব্য সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতি পাননি—এটা মিথ্যাচার; এটা ওনার শপথ লঙ্ঘনের শামিল।’
আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘উনি (রাষ্ট্রপতি) নিজেই ৫ আগস্ট রাত ১১টা ২০ মিনিটে পেছনে তিন বাহিনীর প্রধানকে নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ওনার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং উনি সেটা গ্রহণ করেছেন।’
আইন উপদেষ্টা জানান, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে জানতে ওই সময় রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে আপিল বিভাগের মতামত চাওয়া হয়। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উপদেশমূলক এখতিয়ার প্রয়োগ করে বিষয়টি জানতে চাওয়া হয়। আপিল বিভাগ মত দেয়, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যায়।
আসিফ নজরুল বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনের এমন মতামতের ভিত্তিতে একটা নোট আইন মন্ত্রণালয় থেকে রাষ্ট্রপতির দপ্তরে পাঠানো হয়। এ অভিমতটা রাষ্ট্রপতি দেখেছেন, গ্রহণ করেছেন এবং স্বাক্ষর করেছেন। এরপর তিনি নিজে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছেন।’
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। ওইদিন বিকালে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর দেন। ওইদিন রাতে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি।’
রাষ্ট্রপতির ওই ভাষণ ও আপিল বিভাগের মতামতের কথা উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, ‘একের পর এক কার্যাবলির মধ্য দিয়ে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে উনি (রাষ্ট্রপতি) পুরো জাতিকে বারবার নিশ্চিত করেছেন যে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। প্রায় আড়াই মাস পরে উনি যদি বলেন, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র দেননি, তাহলে এটা স্ববিরোধিতা, শপথ লঙ্ঘন। ওনার এ পদে থাকার যোগ্যতা আছে কিনা সে সম্পর্কে প্রশ্ন চলে আসে।’
আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘উনি (রাষ্ট্রপতি) যদি ওনার বক্তব্যে অটল থাকেন, তাহলে উনি রাষ্ট্রপতি পদে থাকার যোগ্যতায় আছেন কিনা সেটা আমাদের উপদেষ্টামণ্ডলীর সবাইকে ভেবে দেখতে হবে।’
রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আপনার যদি শারীরিক বা মানসিক সক্ষমতা না থাকে বা আপনি যদি গুরুতর অসদাচরণ করেন, তখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে আর ওই পদে থাকতে পারেন কিনা সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ সংবিধানে আছে।’
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র সরকারের কাছে আছে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে আসিফ নজরুল বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ করেছেন, সেটা রাষ্ট্রপতির দপ্তরে থাকার কথা। সংবিধান অনুযায়ী এটি নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলার সুযোগও নেই। এটি ওনার কাজ। উনি নিজেই বলেছেন, পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং তিনি গ্রহণ করেছেন। এখন উনি যদি বলেন নেই, তাহলে পদত্যাগপত্র কী করেছেন, ওনাকেই জিজ্ঞাসা করেন।’
রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। গতকাল রাজধানীতে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে এক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি বলেছেন, শেখ হাসিনার রিজাইন পেপার দেখেননি। যারা দেখেও না দেখার ভান করছেন, তাদের বলতে চাই, আদালত, সচিবালয়সহ বিভিন্ন অফিস থেকে অনেক কিছু চিন্তা করেছিল। এমন অপচিন্তা যারা করছেন, তাদের হুঁশিয়ার করে দিতে চাই, কেউ যদি খুনিদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করেন, তাদের বিরুদ্ধে আবার ছাত্র-জনতা রাজপথে নামবে।’
বিএনপি নেতা ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন মনে করেন, রাষ্ট্রপতি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এ বক্তব্য দিয়েছেন। গতকাল সুপ্রিম কোর্টে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বলেছেন, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। তার এ ভাষণ দেশের মানুষ শুনেছে। রাষ্ট্রপতি নিজে প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টাকে শপথ পড়িয়েছেন। এখন তিনি বলছেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের দালিলিক প্রমাণ নেই। আমি বলব, সরকার গঠনের দুই মাস পরে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে রাষ্ট্রপতি এ কথা বলেছেন। রাষ্ট্রপতি অসত্য বলেছেন।’
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আরো কয়েকজন আইনজীবীও গতকাল বিভিন্ন গণমাধ্যমে একই ধরনের বক্তব্য রেখেছেন।
এদিকে রাষ্ট্রপতির বক্তব্য ঘিরে আলোচনা সম্পর্কে গতকাল একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের প্রেস উইং। তাতে ‘মীমাংসিত’ বিষয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি না করার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। প্রেস উইং থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে প্রচার চালানো হয়েছে, তা জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে, ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবের মুখে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেয়া এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাংবিধানিক বৈধতার ওপর যত ধরনের প্রশ্ন জনমনে উদ্রেক হয়েছে, সেগুলোর উত্তর আপিল বিভাগের আদেশে প্রতিফলিত হয়েছে। তাই মীমাংসিত বিষয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল কিংবা বিব্রত করা থেকে বিরত থাকতে রাষ্ট্রপতি সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন