ইসরায়েলি কর্মকর্তারা দাবি করছেন, সম্প্রতি গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারের নিহত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। অবশ্য হামাসের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের ভয়াবহ হামলার পর থেকে তিনি পলাতক ছিলেন। এরপর থেকেই ইসরায়েলের প্রধান টার্গেট ছিলেন সিনওয়ার। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েলের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সিনওয়ার গত এক বছর ধরে গাজায় লুকিয়ে ছিলেন। একাধিক ইসরায়েলি হত্যাচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন তিনি। তাকে ইসরায়েলের হামাসের হামলার প্রধান নেপথ্য কারিগর হিসেবে ধরা হয়। হামাসের সাবেক নেতা ইসমাইল হানিয়েহের হত্যাকাণ্ডের পর তাকে আগস্টে সংগঠনের নতুন নেতা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। হানিয়েহকে তেহরানে ইসরায়েলের একটি হামলায় হত্যা করা হয়েছিল।
১৯৬২ সালে গাজার খান ইউনিসের একটি শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন সিনওয়ার। হামাস গঠনের প্রথম দিকে, ১৯৮৭ সালে গোষ্ঠীটির সঙ্গে তিনি যুক্ত হন। তিনি হামাসের কট্টর ইসলামি মতবাদ গ্রহণ করেন। এই মতবাদে ইসরায়েলকে নিশ্চিহ্ন করে একটি ইসলামি রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্য রয়েছে বলে দাবি করে আসছে ইসরায়েলিরা। তিনি হামাসের গোয়েন্দা শাখার নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই শাখা ইসরায়েলের গুপ্তচরদের সনাক্ত ও নির্মূলের কাজ করত।
সিনওয়ার ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে ইসরায়েলে গ্রেফতার হন। ওই সময় ১২ জন সন্দেহভাজন গুপ্তচরকে হত্যার কথা স্বীকার করেন তিনি। তার এই কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে ইসরায়েলে ‘খান ইউনিসের কসাই’ বলে ডাকা হতো। তাকে আজীবন কারাবাস দেওয়া হয়েছিল। কারাগারে থাকার সময় তিনি ইসরায়েলি সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন এবং নিজেকে একজন কঠোর নেতায় রূপান্তরিত করেছিলেন।
২০০৮ সালে মস্তিষ্কে ক্যান্সারের চিকিৎসা নিয়েছিলেন সিনওয়ার। ওই সময় ইসরায়েলি ডাক্তাররাই তার চিকিৎসা করেছিলেন। ২০১১ সালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর উদ্যোগে প্রায় এক হাজার ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়। ওই সময় মুক্তি পান সিনওয়ার। বন্দিদের মুক্তির বিনিময়ে ২০০৬ সালে হামাসের হাতে আটক হওয়া ইসরায়েলি সেনা গিলাদ শালিটকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
সিনওয়ার মুক্তির পরও তার কঠোর অবস্থান বদলাননি। গত বছর পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সামরিক লড়াই চালিয়ে যাওয়া, হাজারো ফিলিস্তিনি নিহত এবং তার নিজ অঞ্চলে ধ্বংসযজ্ঞের পরও তিনি সশস্ত্র সংগ্রামকেই ফিলিস্তিনি জাতি গঠনের একমাত্র পথ বলে বিশ্বাস করতেন। চারজন ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দুটি সরকারী সূত্র জানিয়েছেন, এই প্রতিজ্ঞা ছিল তার মধ্যে অটল।
ইসরায়েলে সিনওয়ারকে ‘দুষ্টের মুখ’ বলেও অভিহিত করা হয়। হামাসের তিনজন কর্মকর্তা এবং একজন আঞ্চলিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সিনওয়ার সর্বদা গোপনীয়তা বজায় রাখতেন। নিয়মিত স্থান পরিবর্তন করতেন এবং বিশ্বাসযোগ্য বার্তা বাহকের মাধ্যমে অ্যানালগ পদ্ধতিতে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। যুদ্ধবিরতির আলোচনাগুলোর সময়, বিশেষ করে কাতার ও মিসরের নেতৃত্বে বন্দি ও জিম্মি বিনিময়ের চেষ্টায় তিনি ছিলেন একমাত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। আলোচনাচলাকালীন সিনওয়ার প্রায়ই তার জবাব দিতে করতে কয়েক দিন সময় নিতেন।
ইসলামি আন্দোলনের বিশেষজ্ঞরা বলেন, হামাসের আদর্শে ইসরায়েলকে শুধু একটি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং মুসলিম ভূমিতে একটি দখলদার শক্তি হিসেবে দেখা হয়। এ কারণে, সিনওয়ার ও তার অনুসারীরা যুদ্ধ ও কষ্টকে ইসলামের বৃহত্তর আত্মত্যাগের অংশ হিসেবে মনে করেন। গাজায় তার দুর্ভোগময় শৈশবের স্মৃতির কথা তার ভাষণে প্রায়ই উঠে আসতো। সেখানে তিনি একটি দরিদ্র পরিবারে বড় হন। গাজার অধিবাসী উইসাম ইব্রাহিম জানিয়েছেন, সিনওয়ার একবার বলেছিলেন যে, তার মা জাতিসংঘের খাদ্য সহযোগিতার খালি বস্তা দিয়ে তার জন্য পোশাক তৈরি করতেন।
সিনওয়ার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি ২০২২ সালে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, শত্রুর বিরুদ্ধে তার শক্তিশালী আঘাত হানার ইচ্ছা ছিল এবং একটি যুদ্ধের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। যে যুদ্ধ হয় বিশ্বকে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বাধ্য করবে অথবা ইসরায়েলকে বিশ্বমঞ্চে একঘরে করে দেবে।
গত বছরের ৭ অক্টোবর যদি সেই যুদ্ধের অংশ হয় তাহলে এখন পর্যন্ত তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। যদিও এই ইস্যুটি আবারও বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। কিন্তু একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা এখনও অনেক দূরে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধের পর গাজার জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমাসহ কোনও স্থায়ী পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, এমন কোনও আলোচনা এখন সন্ত্রাসের পুরস্কার হবে।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেতের সাবেক কর্মকর্তা মাইকেল কৌবি। তিনি সিনওয়ারকে কারাগারে ১৮০ ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। তিনি বলেন, সিনওয়ার তার ভয় দেখানোর ক্ষমতা এবং নেতৃত্বের জন্য সুস্পষ্টভাবে আলাদা ছিলেন। কৌবি একবার সিনওয়ারকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কেন তিনি তখনও বিয়ে করেননি। সিনওয়ার উত্তরে বলেছিলেন, ‘হামাস আমার স্ত্রী, হামাস আমার সন্তান। আমার জন্য হামাসই সবকিছু।’
২০০৫ সালে গাজা থেকে ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহারের পর, সিনওয়ার গাজার ভেতরে বিশাল সামরিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে হামাসের মনোবল ও সম্পদ কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। ইসরায়েলের ধ্বংস সাধন ও যুদ্ধ চালানোর জন্য একটি বিশাল ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক, অস্ত্রের মজুদ ও রকেট তৈরির কাজে মনোনিবেশ করেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন