বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মূল কারণ গুম ও খুন। গুম ও খুনের মাধ্যমে দেশজুড়ে ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়েছিল। এই অপকর্মে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ অনেক নেতা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা যুক্ত ছিলেন। গুমের ঘটনা ব্যাপকভাবে ঘটতে থাকে দশম জাতীয় সংসদের একতরফা নির্বাচন সামনে রেখে ২০১৩ সাল থেকে, চলে ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার সরকার পতনের আগ পর্যন্ত।
মূলত বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা যাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলনে যোগ না দিতে পারেন, ক্ষমতাসীনদের লাগামহীন দুর্নীতির পথে বাধা হয়ে না দাঁড়াতে পারেন, সে জন্য তৈরি করা হয় এই ভয়ের সংস্কৃতি। শেষ পর্যন্ত এই ভয় ভেঙেই রাজপথে নেমে আসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা। পতনের আগমুহূর্তেও জনমনে ভীতি সঞ্চারে শেষ অপচেষ্টা করা হয়। প্রাণ দিতে হয় হাজারো ছাত্র-জনতাকে।
আহত হয়েছে অন্তত ২৫ হাজার মানুষ। এই পর্যবেক্ষণ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগেও এই ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করে। ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘সুশাসন ও জবাবদিহির অভাবে দেশবাসী এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতিতে বাস করছে।
মানবাধিকার কয়েকটি মানদণ্ডের ওপর নির্ভর করে। আমরা স্বাধীন বোধ করি কি না, নিজেকে সার্বভৌম মনে করি কি না, অধিকার লঙ্ঘিত হলে ন্যায়বিচার পাব কি না কিংবা আমি শান্তিতে সম্মানের সঙ্গে ও নির্ভয়ে জীবন যাপন করতে পারি কি না—এই প্রশ্নগুলোর জবাব দিয়েই বোঝা যায় আমরা কতটা মানবাধিকার সুবিধা ভোগ করতে পারছি। এসব সূচকে বাংলাদেশ এখনো খুব একটা মানসম্মত জায়গায় পৌঁছতে পারেনি।’
এ বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান গতকাল বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে গুমের ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে। ২০১৩ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গুমের ঘটনা ব্যাপক আকার ধারণ করে।
ওই সময় বিএনপির বহু নেতাকর্মীকে গুম এবং নানাভাবে হয়রানি করা হয়। ২০১৩ সালের পর থেকে ব্যাপকভাবে গুমের ঘটনা ঘটতে থাকে। এর মাধ্যমে একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়, যাতে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলনে যোগ না দেন। এই অপকর্মে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ অনেক নেতা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা যুক্ত ছিলেন। আওয়ামী লীগ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা মিলিতভাবে গুমের ঘটনাগুলো ঘটিয়েছেন। আমাদের সংগঠনের কাছে এই মুহূর্তে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মোট ৭০৯ জনকে গুম করার তথ্য রয়েছে। এর পরও ৫ আগস্ট পর্যন্ত অনেক গুম ও খুনের ঘটনা ঘটেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলার সময় অনেককে গুম করা হয়। আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদকে গুম করা হয়। বিএনপিসহ ভিন্নমতের অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।’
তিনি জানান, ১৬ বছরে গুমের শিকার ৭০৯ জনের মধ্যে ৮৩ জনের লাশ পাওয়া গেছে। ফিরতে পেরেছেন ৪৭১ জন। ফেরেননি ১৫৫ জন।
নাসির উদ্দিন এলান আরো বলেন, ‘গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশন এরই মধ্যে আয়নাঘর পরিদর্শন করেছে। আমরা আশা করছি, কমিশনের প্রতিবেদনে গত ১৬ বছরে গুমের ঘটনায় কারা জড়িত ছিল, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।’
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) চেয়ারপারসন ও প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, তিনটি অপরাধে আওয়ামী লীগের পতন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। এগুলো হচ্ছে, গুম, খুন ও দুর্নীতি। এ তিনটি অপরাধই হচ্ছে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। দুর্নীতির পথে কেউ যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়াতে পারে, ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ যাতে না থাকে তার জন্য গুম ও খুনের পথ বেছে নেন দলটির শীর্ষ নেতারা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদেরও এসব অপরাধের সহযোগী করে তোলা হয়।
গুম নিয়ে উদ্বেগ এবং তদন্তে যা জানা গেছে
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে গুমের ঘটনা তদন্তে গত ২৭ আগস্ট হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কমিশনের কার্যপরিধিতে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, তাদের শনাক্ত এবং কোন পরিস্থিতিতে গুম হয়েছেন, তা নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তার আগে গত ২৫ আগস্ট সোমবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, অপহরণ এবং ‘আয়নাঘরের’ মতো চরম ঘৃণ্য অপকর্মের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। এরপর গত ২৯ আগস্ট গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সই করে বাংলাদেশ।
গুমের ঘটনায় দীর্ঘদিন তদন্তের দাবি জানিয়ে আসছে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন মায়ের ডাক। সংগঠনটি গত ১৮ আগস্ট বিভিন্ন সময়ে গুমের শিকার ১৫৮ ব্যক্তির একটি তালিকা প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালকের কাছে দেয়। এর আগে ২০২১ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে গুমের শিকার ৭৬ জনের একটি তালিকা বাংলাদেশের তত্কালীন সরকারকে দেয়। ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাশেলেত ঢাকা সফরের সময় এই তালিকা নিয়ে তত্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। এরপর ওই বছরের ১৭ আগস্ট ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে তিনি গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানান।
এদিকে তদন্ত কমিশন গত ৩ অক্টোবর গণমাধ্যমকে জানায়, কার্যক্রম শুরুর পর ১৩ কর্মদিবসে গুম সম্পর্কিত ৪০০ অভিযোগ জমা পড়ে। ভুক্তভোগীদের দেওয়া অভিযোগ অনুযায়ী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) কার্যালয়ে গিয়ে গোপন বন্দিশালার সন্ধান পাওয়া গেছে। ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলটি (জেআইসি) ডিজিএফআইয়ের সদর দপ্তরের ভেতরেই। দোতলা ওই ভবনে ২২টি সেল আছে।
কমিশনের সভাপতি হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী কর্তৃক যারা গুম হয়েছেন তাদের অভিযোগগুলো নিয়েই আমরা কাজ করেছি। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদেরও আমরা ডাকব। বক্তব্যের জন্য সমন দেব। অভিযুক্তরা না এলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
গণমাধ্যমকে তিনি আরো বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি গুমের অভিযোগ এসেছে র্যাব, ডিজিএফআই, ডিবি ও সিটিটিসির বিরুদ্ধে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর আমরা ডিজিএফআইয়ের আয়নাঘর পরিদর্শন করেছি। ১ অক্টোবর আমরা ডিবি ও সিটিটিসি পরিদর্শন করেছি। তবে সেখানে কোনো বন্দি আমরা পাইনি। সম্ভবত ৫ আগস্টের পর সেখান থেকে সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’
আলোচিত কিছু গুম, খুন
২০১০ সালের ২৫ জুন গুমের শিকার হন তত্কালীন ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৬ নম্বর (বর্তমান ঢাকা দক্ষিণের ২০) ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম। তাকে ফার্মগেটের ইন্দিরা রোড থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো তার খোঁজ মেলেনি। তাঁর পরিবারের সদস্যরা জানে না তিনি জীবিত আছেন নাকি মৃত।
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়া দেশের একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। তাকে এবং তার গাড়ির চালক আনসার আলীকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোক দাবি করে ঢাকার বনানী এলাকা থেকে অপহরণ করা হয়। আজ পর্যন্ত তার খোঁজ মেলেনি।
২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান এবং বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিককে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। ওই দিন বিকেল পৌনে ৩টার দিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের পাশে ভূঁইয়া ফিলিং স্টেশনের সামনে থেকে অস্ত্রের মুখে তাকে তুলে নেওয়া হয়। পরের দিন রাত আড়াইটার দিকে পকেটে ৩০০ টাকা দিয়ে অপহরণকারীরা তাঁকে মিরপুর আনসার ক্যাম্পের কাছে নামিয়ে দিয়ে যায়। এই ৩৫ ঘণ্টার পুরো সময়টাতেই তার চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে সিটি করপোরেশনের তত্কালীন কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে হত্যা করে তাদের লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। পরে জানা যায় যে নজরুল ইসলামকে অপহরণ করার সময় দেখে ফেলায় আইনজীবী চন্দন সরকারসহ অন্য ছয়জনও অপহরণ এবং পরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। অপহরণের তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে তাদের মরদেহ। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সারা দেশের মানুষ ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। সে সময় প্রশ্ন ওঠে, সরকারপ্রধান এবং র্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তাদের জানার বাইরে এই হত্যাকাণ্ড কিভাবে ঘটতে পারে। আলোচিত সাত খুন মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সাবেক সেনা ও র্যাবের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ আদালতে ১৬৪ ধারায় যে জবানবন্দি দেন তাতে তিনি ঘটনার জন্য সম্প্রতি বরখাস্ত ও গ্রেপ্তার হওয়া মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে দায়ী করেন। জিয়াউল আহসান তখন সেনাবাহিনীর কর্নেল ছিলেন এবং র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। ওই নৃশংস ঘটনার দায় অধীন তারেক সাঈদের ওপর চাপিয়ে তিনি পার পেয়ে যান।
চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান অনেকের কাছেই ছিলেন মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম। শেখ হাসিনার সরকারের সময় নানাভাবে আলোচনায় এসেছিলেন তিনি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ফোনে আড়ি পেতে কল রেকর্ড ফাঁস, অপহরণ-গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ নানা অভিযোগ শোনা গেছে তাঁর বিরুদ্ধে।
২০১৬ সালের ৩ জুলাই সকালে তত্কালীন সরকারের কঠোর সমালোচক ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহার অপহূত হন। এর ১৮ ঘণ্টা পর গভীর রাতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা নাটকীয়ভাবে তাকে যশোর থেকে উদ্ধার করেন। পরে ফরহাদ মজহার জানান, তাকে অপহরণ করে সীমান্তের ওপারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল এবং পুলিশ তাকে উদ্ধারের পর চাপ প্রয়োগ করে মিথ্যা স্বীকারোক্তি নেওয়ার চেষ্টা করেছে।
২০১৮ সালের ২৬ মে রাতে টেকনাফের কায়ুকপাড়া এলাকা থেকে কাউন্সিলর একরামুল হককে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দিন কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সড়কে তার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। মৃত্যুর আগমুহূর্তে ফোনালাপে একরামুলের শিশুকন্যার আকুল কণ্ঠস্বর ছিল, ‘আব্বু, তুমি কানতেছ যে?’ এই কণ্ঠস্বরের সঙ্গে গুলির শব্দ স্পষ্ট শোনা যায়।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মীর নির্মম নির্যাতনে নিহত হন আবরার ফাহাদ। বুয়েটের তড়িত্ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন আবরার।
আবরার হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে পাঁচ বছর আগে উত্তাল হয়ে উঠেছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। সেই সঙ্গে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। এটি তখন শিরোনাম হয়েছিল বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। এর জের ধরে তীব্র আন্দোলনের মুখে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
এবার আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের মিছিল, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, পোস্টার ও স্লোগানে আবরার ফাহাদের নাম উঠে আসে।
২০২০ সালের ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে থেকে গুম করা হয় সাংবাদিক কাজলকে। তারপর যমটুপি পরিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মাটির নিচের কোনো অজ্ঞাত স্থানে। এর ৫৩ দিন পর গভীর রাতে যশোরে বেনাপোল সীমান্তের একটি মাঠ থেকে তাকে উদ্ধার করার কথা বলা হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। এরপর একাধিক মামলায় তাকে কারাগারে থাকতে হয় অনেক দিন। প্রায় ৯ মাস পর বাড়ি ফিরতে পারেন তিনি।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নিজ বাসায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনিকে। আজ পর্যন্ত মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়নি। এই নৃশংস ঘটনায় দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সরকার কারো বেডরুমে পাহারা বসাতে পারে না। অনেকের ধারণা, তত্কালীন সরকারের প্রভাবশালী কেউ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকায় হত্যার রহস্য উদঘাটিত হয়নি।
২০১৩ সালের ৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জের সুধীজন পাঠাগারে প্রতিদিনের মতো সেদিনও যাচ্ছিলেন তানভীর মোহাম্মদ ত্বকী। খুনি সন্ত্রাসীগোষ্ঠী পথ থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় তাদের টর্চার সেলে। বহুজন মিলে ত্বকীর ওপর অনেকভাবে ক্রমাগত নির্যাতন করে। একসময় তানভীর মোহাম্মদ ত্বকী মারা গেলে তার লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় শীতলক্ষ্যা নদীতে। সে সময় ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ও দেশ ছাড়লে ‘আয়নাঘর’ (গোপন বন্দিশালা) থেকে মুক্তি পান সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আযমী, ব্যারিস্টার আরমান ও মাইকেল চাকমা। আট বছর পর আলোর মুখ দেখেন তারা।
গত ৫ অক্টোবর রাজধানীর রাওয়া ক্লাবে সাবেক সামরিক কর্মকর্তাদের এক সেমিনারে গুমের শিকার লে. কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান বলেন, ‘আয়নাঘরের মূল কারিগর সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, জিয়াউল আহসান ও মামুন খালেদ। আওয়ামী লীগ সরকার আমার ওপর যে নিপীড়ন করেছে তা অবর্ণনীয়। আমাকে আমার কর্মস্থল থেকে তুলে নিয়ে গুম করা হয়। পরে কোর্ট মার্শালে নেওয়া হয়। সে সময় আমাকে এবং আমার পরিবারকে হেনস্তা করা হয়েছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে আমি সেনাবাহিনী থেকে পুরস্কৃতও হয়েছিলাম, সেই আমাকেই জঙ্গি তকমা দেওয়া হয়েছে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন