প্রথম আলো: জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান–পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর: এখনই পুরোপুরি মূল্যায়ন করার সময় এসেছে বলে মনে করি না। কারণ, এক-দেড় মাস খুবই অল্প সময়। আর পরিবর্তনের পর যে সরকার এসেছে, সেই সরকারের অবস্থান, শক্তি ও সক্ষমতা তো আমাদের বুঝতে হবে। এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস খুব জনপ্রিয় মানুষ। এ দেশের মানুষ ও সারা পৃথিবী তাঁকে শ্রদ্ধা করে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে তাঁর সে রকম কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তবে তিনি তাঁর সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করছেন।
দ্বিতীয়ত, সরকারের অন্যদের মধ্যে তিন-চারজন বাদ দিয়ে বাকিদের সেভাবে সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই। এর মধ্যে তাঁরা কিছু ভালো ব্যবস্থা নিয়েছেন। তবে একটা জায়গায় আমার খটকা আছে, তাঁরা সংস্কারের জন্য যে ছয়টি কমিশন করলেন, এটা করার আগে তাঁদের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলা উচিত ছিল। একটা বিষয় হচ্ছে, রাজনীতিকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা লক্ষণীয়। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাদের মতামত জানতে হবে এবং তার ভিত্তিতে সরকার এগোতে পারবে।
প্রথম আলো: অভ্যুত্থানে মানুষ আসলে কী চেয়েছে, এখন কী চাইছে?
মির্জা ফখরুল: মানুষ প্রাথমিকভাবে চেয়েছে আওয়ামী লীগের পতন। কারণ, আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরে রাজনীতি ও অর্থনীতি একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে; প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে। সে জন্য মানুষ আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন চেয়েছে। সরকার বলছে যে ইনসাফের রাজনীতি বা সাম্যের রাজনীতি চালু করব। আমরাও বলছি। আমরা সংস্কারের ৩১ দফা দিয়েছি। সরকারের কাজ দৃশ্যমান হতে হবে।
প্রথম আলো: কিন্তু আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনের পতন ঘটাতে আপনারা পারলেন না, ছাত্ররা পারলেন। কেন?
মির্জা ফখরুল: এটা সঠিক নয়। আমি এর সঙ্গে একমত না। আমরা রাজনীতিকেরা পুরো ক্ষেত্রটা তৈরি করেছি। জুলাইয়ে এই আন্দোলন শুরুর আগে পর্যন্ত আপনারা দেখেছেন আমরা কীভাবে আন্দোলন করেছি। এমনকি এই জুলাইয়ে সবার আগে জেলে গেছে আমাদের লোকজন। যেদিন এই আন্দোলন শুরু হয়েছে, তার পরের দিন ঢাকা শহর থেকে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নজরুল ইসলাম খানসহ আমাদের ৯ হাজার লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই আন্দোলনে আমাদের হিসাবমতে ৪২২ জন বিএনপির নেতা-কর্মী-সমর্থক নিহত হয়েছেন। আন্দোলনের ক্ষেত্রটা পুরোপুরিভাবে তৈরি করা। এখানে ছাত্ররা এসেছে কোটা আন্দোলন নিয়ে। সেই কোটা আন্দোলনটাকে মিস হ্যান্ডলিং (সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারেনি) করেছে আওয়ামী লীগ। সেটা না হলে এই আন্দোলন কোন পর্যায়ে যেত, তা বলা মুশকিল। তবে হ্যাঁ, ছাত্রদের একটা সুবিধা আছে। যেটা আমি বারবার বলেছি যে তরুণেরা, যুবকেরা, ছাত্ররা এগিয়ে না এলে কখনোই আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে যাবে না।
প্রথম আলো: এই আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের বার্তাটা কী? এটা কি রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে অনাস্থা?
মির্জা ফখরুল: আমি সেটা মনে করি না। আজকে সে ধরনের একটা ন্যারেটিভ (ধারণা) তৈরি করা হচ্ছে যে রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে একটা বার্তা দেয়। হ্যাঁ, অতীতের যে অভিজ্ঞতা রাজনৈতিক দলগুলোর শাসন নিয়ে; বিশেষ করে আওয়ামী লীগ গত ১৫ বা ১৬ বছরে যেটা করেছে, তাতে করে এ ধরনের একটা অনীহা তৈরি হয়েছে; এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দুঃশাসন চলেছে। স্বাভাবিকভাবেই এটা একটা বিষয় হতে পারে। কিন্তু আপনি যখন দেশ পরিচালনা করবেন, তখন তো রাজনীতিবিদ ছাড়া সম্ভব নয়।
প্রথম আলো: আপনারা এখন কী চাইছেন?
মির্জা ফখরুল: আমরা চাইছি, নির্বাচনব্যবস্থা, প্রশাসন ও বিচার বিভাগ, বিশেষ করে এই তিনটি ক্ষেত্রে দ্রুত সংস্কার করা হোক। এটা করেই দ্রুত নির্বাচন আমরা চাইছি।
প্রথম আলো: আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান কী?
মির্জা ফখরুল: আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচন করে, জনগণ সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। আমি তো সিদ্ধান্ত দেওয়ার মালিক না। আমি নির্বাচন করব, অন্য দলগুলো করবে, জনগণ যাদের বেছে নেবে, তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
প্রথম আলো: তাহলে কি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিলে আপনাদের আপত্তি থাকবে না?
মির্জা ফখরুল: আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে নেবে। কিন্তু যে ব্যক্তিগুলো গণহত্যা, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, তাঁরা যেন নির্বাচনে অংশ না নেন, সেটাই আমাদের বক্তব্য। কোনো দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে তো আপত্তি করার কিছু নেই।
প্রথম আলো: কিন্তু আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার আলোচনা উঠছে কোনো কোনো মহলে। এ ব্যাপারে আপনাদের অবস্থান কী?
মির্জা ফখরুল: না। আমরা চাই না, দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হোক। কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে আমরা নই। কারণ, আমরা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। তবে আওয়ামী লীগের যাঁরা নানা অপরাধ করেছেন, যাঁরা গণহত্যা করেছেন, সেই ব্যক্তিরা রাজনীতি করতে পারবেন না, জনগণ সেটা চায়। তাঁদের অপরাধের বিচার করতে হবে। কিন্তু গণতন্ত্রে কোনো দলের রাজনীতি করার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া যায় না।
প্রথম আলো: আপনারা অন্তর্বর্তী সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বলছেন। আবার দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন চাইছেন। এই যৌক্তিক বা দ্রুত সময় আসলে কতটা? মানে আপনাদের রেডলাইনটা কোথায়?
মির্জা ফখরুল: না...কতটা সময় এখন আমি বলতে পারব না। কারণ, তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) আসলে কী করবে, কতটুকু তারা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে করবে, সেটা তাদের ওপর নির্ভর করে। সে জন্য এখন সময়টা আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে আমি কথাগুলো এ কারণে বারবার বলছি যে আপনি যত বেশি সময় দেবেন, তত বেশি রাজনীতিবিরোধী শক্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে এবং তাদের যে ভূমিকা থাকে বিভিন্নভাবে পেছন থেকে জনগণের শাসনকে পিছিয়ে দেওয়ার, তারা সক্রিয় হবে।
প্রথম আলো: আপনি তিনটি বিষয়ে সংস্কারের কথা বললেন। ইতিমধ্যে গঠিত ছয়টি কমিশন সংস্কারের সুপারিশ দেওয়ার পর তা নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য ও ভোটার তালিকা তৈরি হলে দ্রুত নির্বাচনের তারিখ ঠিক করার কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ ব্যাপারে কিন্তু কোনো দল থেকে আপত্তি আসেনি।
মির্জা ফখরুল: না...এখানে আপত্তি নয়, আমাদের বক্তব্য আছে। সেটা হচ্ছে, এটা তো অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য করা যাবে না। আমি জোর দিতে চাই, যে সংস্কার আপনি করবেন তার মূল লক্ষ্য হচ্ছে সবার অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা; যে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা জাতীয় সংসদ গঠন করতে পারব। এটা যদি করতে না পারি, তাহলে বিভিন্ন রকম সমস্যা তৈরি হবে এবং সে সমস্যাগুলো তখন কিন্তু সামাল দেওয়া মুশকিল হবে। অভিজ্ঞতা থেকে বলি, এটা আপনি বিরাজনীতিকরণের সুযোগ করে দেবেন। যেটা ওয়ান-ইলেভেনে হয়েছিল।
প্রথম আলো: কিন্তু সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছেন। বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ তা সমর্থন করেছেন।
মির্জা ফখরুল: এগুলো যাঁরা বলছেন, তাঁদের নিজস্ব বক্তব্য। এ কথাগুলো সেনাপ্রধানই বলুন বা সরকারপ্রধানই বলুন, আমি বলি, এখানে গ্যাপটা (ঘাটতি) হচ্ছে, তারা এখনো সুনির্দিষ্টভাবে কোনো রোডম্যাপ দেয়নি। আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি যে এ সরকারের একটা রোডম্যাপ দেওয়া উচিত।
প্রথম আলো: নির্বাচন না কি সংস্কারের রোডম্যাপ চাইছেন?
মির্জা ফখরুল: আমরা সব বিষয়ে, মানে তারা (সরকার) নির্বাচনের জন্য কত দিন সময় নেবে এবং সংস্কারে কত দিন। সংস্কার আমাদের কাছে অগ্রাধিকার নয়—এটা আমি পরিষ্কার করে বলছি। আমি মনে করি, নির্বাচনের জন্য যতটুকু দরকার, সেটা করুন। সংস্কার করার মূল দায়িত্ব কিন্তু হবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের। আপনাকে যদি প্রশ্ন করি যে হু আর ইউ, আপনি কে—এসব সংস্কার করছেন, সংবিধান সংস্কার করছেন। আপনি কে আসলে? আপনার স্ট্যাটাসটা কী? একটা আন্দোলন করে ছেলেরা আপনাকে বসিয়ে দিয়েছে আর আপনি সব দায়িত্ব পেয়ে গেছেন। আই ডোন্ট থিংক সো (আমি সেটা মনে করি না)। আপনাকে অবশ্যই এটা জনগণের মাঝ থেকে আনতে হবে। আর জনগণ থেকে আসার একমাত্র পথ হচ্ছে নির্বাচন।
প্রথম আলো: কিন্তু বলা হচ্ছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে। তাদের প্রতি জনগণের সমর্থন আছে।
মির্জা ফখরুল: তাহলে বিপ্লবী সরকার গঠন করল না কেন। তারা এই সংবিধানের অধীনেই তো শপথ নিয়েছে। এখন নির্বাচন করার জন্য সংবিধানে যতটুকু সংশোধনী আনা দরকার, ততটুকুই তাঁরা করবেন। সেটার জন্য যদি ছয় মাস বা এক বছর লাগে, সেটা লাগুক। কিন্তু এমনটা নয় যে পুরোটাই তাঁরা করবেন। তাহলে জনগণের প্রতিনিধিত্ব থাকবে কোথায়? তাঁরা যদি মনে করেন তাঁরা নিজেরাই জনগণ, আমি তো এর সঙ্গে একমত হব না।
প্রথম আলো: কিন্তু আপনারাও তো সুনির্দিষ্ট করে কোনো সময় বলছেন না।
মির্জা ফখরুল: আমাদের পক্ষে সময় বলা তো মুশকিল। তাঁরা বিষয়গুলো করবেন। সেখানে আমি একটা সময় বলে দিয়ে সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি করতে চাই না। আমরা তাঁদের যথেষ্ট সময় দিতে চাই। কারণ, তাঁদের তো আমরাই এনেছি। কিন্তু জনগণের পক্ষে কাজ করার সেই সুযোগটা তাঁদের নিতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন